• মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ১০ ১৪৩১

  • || ১৩ শাওয়াল ১৪৪৫

সর্বশেষ:
যুদ্ধের অর্থ জলবায়ু পরিবর্তনে ব্যয় হলে বিশ্ব রক্ষা পেত- প্রধানমন্ত্রী দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদনের রেকর্ড মেডিকেল কলেজের ক্লাস অনলাইনে নেয়ার নির্দেশ স্বাস্থ্যমন্ত্রীর ‘গণতান্ত্রিক রীতিনীতি না মানলে জনগণই বিএনপিকে প্রতিহত করবে’ লালমনিরহাটে হত্যা মামলায় বিএনপির দুই নেতা কারাগারে

বঙ্গবন্ধুকন্যা থেকে জননেত্রী 

প্রকাশিত: ২৯ অক্টোবর ২০২০  

বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ আমাদের দেশের সর্ববৃহৎ, অন্যতম প্রাচীন, ঐতিহ্যবাহী ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার একটি রাজনৈতিক দল। ১৯৪৯ সালে ২৩ জুন প্রতিষ্ঠা লাভের পর দীর্ঘ সাত দশকেরও অধিক সময় ধরে আওয়ামী লীগ আমাদের জাতীয় রাজনীতির অগ্রভাগে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে আসছে। বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমরা স্বাধীনতা লাভ করেছি। সংগঠনগতভাবে এটাই আওয়ামী লীগের সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ছিল বাঙালি জাতির মুক্তি বা স্বাধীনতা; ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা তা লাভ করি।

বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় স্বপ্ন ছিল ক্ষুধা, দারিদ্র্য, অশিক্ষা ও কুসংস্কারমুক্ত একটি গণতান্ত্রিক-অসাম্প্রদায়িক উন্নত-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধুর কথায় সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠা। অর্থাৎ জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তি, সমাজের বঞ্চিত-অবহেলিত, ক্ষমতাহীন ও অধিকারহীন মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা। বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে তিনি ১৯৭৫ সালের জানুয়ারি মাসে দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি গ্রহণ করেছিলেন। সেই কর্মসূচি গ্রহণের মাত্র আট মাসের মধ্যে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধবিরোধী গোষ্ঠীর ষড়যন্ত্রের ধারাবাহিকতায় একদল ঘাতক পরিবারের উপস্থিতিতে সব সদস্যসহ বঙ্গবন্ধুকে অত্যন্ত নিষ্ঠুর ও নির্মমভাবে হত্যা করে। এরপর বাংলাদেশ দীর্ঘ ১৫ বছরের জন্য খন্দকার মোশতাক, জিয়াউর রহমান ও এরশাদের অধীনে তথা সামরিক শাসনের অধীনে চলে যায়।

খন্দকার মোশতাক মাত্র ৮৩ দিন ক্ষমতায় ছিলেন এবং ওই সময় তিনি বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচার যাতে না হয় সে জন্য ইনডেমনিটি আইন পাস করেছিলেন। মোশতাকের পতনের পর জিয়াউর রহমান রাজনীতির অগ্রভাগে চলে আসেন এবং ১৯৮১ সালের ৩০ মে ক্ষমতায় ছিলেন। এরপর চট্টগ্রামে এক ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থানে তিনি নিহত হন। জিয়াউর রহমান ১৯৭৯ সালে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীতে ইনডেমনিটি আইনকে সংবিধানের অংশভূত করেন। কিন্তু পরবর্তী পর্যায়ে উচ্চ আদালত কর্তৃক তা অসাংবিধানিক হিসেবে ঘোষিত হয়। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর মুক্তিযুদ্ধবিরোধীরা ক্ষমতায় আসীন হয় এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি আওয়ামী লীগসহ সমমনা দলগুলোর নেতাকর্মী-সমর্থকদের ওপর চরম জুলুম-নির্যাতন চালায়। কার্যত মুক্তিযুদ্ধের চেতনা-আদর্শকে উল্টে দিয়ে পাকিস্তানি সাম্প্রদায়িক ও সেনা-আমলা শাসনাধীনে বাংলাদেশ পরিচালিত হতে থাকে।

বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে আওয়ামী লীগের পুনর্গঠন প্রক্রিয়া ও নেতৃত্ব নিয়ে দলের মধ্যে কোন্দল চরম আকার ধারণ করে। ১৯৭৮ সালের কাউন্সিলে মরহুম আবদুল মালেক উকিলকে সভাপতি ও মরহুম আবদুর রাজ্জাককে সাধারণ সম্পাদক করা হয়। এই কমিটি মেনে নিতে না পেরে মিজানুর রহমান চৌধুরী পাল্টা আওয়ামী লীগ গঠন করেন; যা আওয়ামী লীগ মিজান নামে পরিচিত। এর কিছুদিন পর দেওয়ান ফরিদ গাজী একইভাবে দল গঠন করেন। এভাবে আওয়ামী লীগ একাধিক দলে বিভক্ত হয় এবং নেতৃত্ব নিয়ে সংকট তৈরি হয়। ১৯৭৮ সালের পর ১৯৮১ সালে আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়। সেই কাউন্সিল সামনে রেখে দলের মধ্যে অনেক উপদল গঠন হয় ও নেতৃত্ব নিয়ে চরম দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। ওই সময় বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ভারতে নির্বাসিত জীবনযাপন করছিলেন। তখন দলের ঐক্যের স্বার্থে আওয়ামী লীগ নেতারা বিদেশে অবস্থানরত শেখ হাসিনাকে সভানেত্রী নির্বাচন করেন। সভানেত্রী নির্বাচিত হওয়ার মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগের ঐক্যের প্রতীক হিসেবে আবির্ভূত হন শেখ হাসিনা। এরপর ওই বছরের ১৭ মে দেশে প্রত্যাবর্তন করেন শেখ হাসিনা। দেশে ফিরেই তিনি সেনা শাসকের হাত থেকে দেশের পুনরুদ্ধারের সংগ্রাম শুরু করেন। ১৯৮১ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার আন্দোলন চলেছে। রাজনৈতিক জোট গঠন হয়েছে এরশাদের স্বৈরাচার শাসনের বিরুদ্ধে। এরশাদের নয় বছরের শাসনকাল ছিল আন্দোলন-সংগ্রামে পরিপূর্ণ। এরশাদবিরোধী আন্দোলনে রাজনৈতিক জোটসহ দেশের বিভিন্ন পেশাজীবী শ্রেণির মানুষ অংশ নেয়। এরশাদের পতনের পর ১৯৯১ সালের নির্বাচনে সব দল অংশগ্রহণ করে এবং বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট সরকার গঠন করে। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দীর্ঘ ২১ বছর পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে। এরপর ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি আবার ক্ষমতায় আসে এবং ২০০৬ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকে। ২০০৭ সালের জানুয়ারি থেকে ২০০৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিল ড. ফখরুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার। তবে ফখরুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছিল সেনা শাসনের মুখোশ মাত্র।

১৯৮১ থেকে শুরু করে ২০০৮ সাল পর্যন্ত মানুষের অধিকার ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য শেখ হাসিনাকে দীর্ঘ সংগ্রাম করতে হয়েছে। সেনা শাসন থেকে গণতন্ত্রের পুনরুদ্ধারে শেখ হাসিনার নেতৃত্ব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। তার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সুসংগঠিত হয়েছে, পাশাপাশি তার আভির্ভাব ঘটে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির ঐক্যের প্রতীক হিসেবে। বাংলাদেশের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে শেখ হাসিনার নেতৃত্ব ও অবস্থান ছিল সুদৃঢ়। গত চার দশক ধরে তিনি রাজনীতির অগ্রভাগে রয়েছেন এবং মোট চার মেয়াদে ক্ষমতায় এসেছেন। তবে ক্ষমতায় বা বিরোধী দলে যে কোনো অবস্থাতেই তিনি সবসময় মুক্তিযুদ্ধবিরোধীদের নিশানায় পরিণত হয়েছেন। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল না। হামলার মূল লক্ষ্য ছিল শেখ হাসিনাকে হত্যা করা। চট্টগ্রামে জনসভা করতে গিয়ে তিনি হামলার শিকার হন। সেখানেও বহু নেতাকর্মীকে জীবন উৎসর্গ করতে হয়েছে। এ ছাড়া নানাভাবে তাকে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে। তিনি ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসার পর জঙ্গিগোষ্ঠী বিভিন্ন জায়গায় তাদের তৎপরতা চালিয়েছে। ২০১৪ সালের নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ না করে সন্ত্রাসী তৎপরতা চালিয়ে মানুষ হত্যা করেছে। সরকারের এক বছর পূর্তিতে ২০১৫ সালে মোট ৯০ দিন তারা সহিংস আন্দোলন করেছে; পেট্রোল বোমা নিক্ষেপ করে মানুষ হত্যা করেছে। ৩৯ বছরের রাজনৈতিক জীবনে কমপক্ষে ২৪ বার শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে।

শেখ হাসিনা শুধু গণতন্ত্রই পুনরুদ্ধার করেননি; পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তিনি বাহাত্তরের সংবিধানের মূল চার মূলনীতিকে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করেছেন। তিনি বঙ্গবন্ধুর আত্ম-স্বীকৃত খুনিদের বিচার করেছেন; যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করেছেন। বলা যেতে পারে, মুক্তিযুদ্ধের পরে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য শেখ হাসিনাকে আরেকটি ছোট মুক্তিযুদ্ধ করতে হয়েছে।

মোট চার মেয়াদে ক্ষমতায় এসেছেন শেখ হাসিনা। এই সময়ের মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি হয়েছে, নারীর ক্ষমতায়ন হয়েছে, শিক্ষার হার বেড়েছে, গড় আয়ু বেড়েছে, প্রবৃদ্ধির হার বেড়েছে। দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়েছে। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প, মেট্রোরেল, কর্ণফুলী ট্যানেল, পায়রায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের কাজ চলছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো- বিশ্বব্যাংককে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ এগিয়ে নেওয়ার বিষয়টি, যা বাংলাদেশকে বিশ্ব দরবারে নতুন করে তুলে ধরেছে। শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার আগে তিন হাজার ৩০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হতো। বর্তমানে ২০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে। শিক্ষা, অর্থনীতিসহ সর্বক্ষেত্রে তিনি পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন। ১০০ বছর পরে বাংলাদেশের অবস্থা কেমন হবে- সে ব্যাপারেও তিনি ডেল্টা পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন। তার সরকারের সময়ে শহীদ দিবসকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে ইউনেস্কো।

বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ছিল আত্মমর্যাদাশীল জাতি গঠন করার। বঙ্গবন্ধুর সেই বাস্তবায়নের পথে এগিয়ে যাচ্ছে। এখন জাতীয় বাজেটের ৯০ শতাংশ ধরা হচ্ছে নিজস্ব অর্থায়ন থেকে। শত্রু-মিত্র সবাই আজ স্বীকার করছেন যে, বাংলাদেশ উন্নয়নের ক্ষেত্রে বিশ্বেব রোল মডেল স্থাপন করেছে। আন্তর্জাতিকভাবে তৃতীয় বিশ্বের তিনজন সরকারপ্রধানের নাম ঘোষণা করা হয়েছে, যারা দুর্নীতিমুক্ত; তার মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অন্যতম। দুর্নীতিমুক্ত নেতা বা সরকারপ্রধান নিঃসন্দেহে একটি জাতির বড় সম্পদ। তিনি দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি ঘোষণা করেছেন। দলের মধ্যে থেকে যারা দুর্নীতি করেছেন তাদের অনেককে তিনি শাস্তি দিয়েছেন, অনেককে দল থেকে বের করে দিয়েছেন।

দীর্ঘ ৪০ বছর থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশর প্রাচীনতম রাজনৈতিক দলের প্রধান হিসবে মানুষের কল্যাণে নিরলস কাজ করে চলেছেন। শেখ হাসিনা বাংলাদেশের উন্নয়নের পথিকৃৎ। তার নেতৃত্বেই জাতি আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠেছে। তিনি আরও কিছুকাল জাতিকে নেতৃত্ব দিয়ে গেলে জাতির পিতার স্বপ্নপূরণে তিনি সফল হবেন। ২৮ সেপ্টেম্বর জননেত্রী শেখ হাসিনার ৭৪তম জন্মদিন ও ৭৩তম জন্মবার্ষিকী। এই শুভ জন্মদিনে তাকে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানাই। তিনি আরও দীর্ঘজীবী হোন এবং জননেত্রী হিসেবে জাতির পিতার স্বপ্নপূরণে তিনি নেতৃত্ব দেবেন; তার নেতৃত্বেই জাতির পিতা ও জাতির স্বপ্নপূরণ হবে এই কামনা করি।

লেখক : ড. হারুন-অর-রশীদ
উপাচার্য, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়

– দৈনিক পঞ্চগড় নিউজ ডেস্ক –