• বুধবার ০৯ অক্টোবর ২০২৪ ||

  • আশ্বিন ২৪ ১৪৩১

  • || ০৪ রবিউস সানি ১৪৪৬

বঙ্গবন্ধু সোনার বাংলা ও ১৫ আগস্ট

প্রকাশিত: ১৫ আগস্ট ২০২৩  

ড. নাসিম বানু

১৫ আগস্ট বাঙালি জাতির ইতিহাসে এক কলঙ্কজনক দিন, শোকের দিন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরাজিত শক্তি দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীদের দোসর একদল সেনা সদস্য জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন দুঃস্বপ্নে পরিণত করে। বাংলাদেশের অগ্রসরমাণ উন্নয়ন যাত্রাকে বাধাগ্রস্ত করে দেশকে পেছনের দিকে নিয়ে যাওয়ার মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জনকে অকার্যকর করার উল্লাসে মেতে ওঠে।

বঙ্গবন্ধুর লালিত স্বপ্ন ছিল বাংলাদেশের ভূখণ্ডকে সোনার বাংলায় পরিণত করা; যেখানে দারিদ্র্য, বঞ্চনা, সাম্প্রদায়িকতা থাকবে না, বিরাজ করবে মানবিক মূল্যবোধ, সাম্য ও সামাজিক ন্যায়বিচার। এই লক্ষ্য পূরণে বঙ্গবন্ধু সারা জীবন তাঁর রাজনৈতিক কার্যক্রম পরিকল্পিতভাবে করে গেছেন, দেশবাসীকে বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনায় সংগঠিত করেছেন, উদ্বুদ্ধ করেছেন। বাংলা ভাষার ওপর আঘাত এলে ১৯৫২ সালে আঘাত রুখে দিতে বঙ্গবন্ধু অনন্য ভূমিকা পালন করেন, বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষা করেন, অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে ছয় দফা দাবি পেশ করে ১৯৬৬ সালে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেন, সামরিক আইনের আওতায় ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে তিনি বাংলাদেশের জনগণের আকাঙ্ক্ষা পূরণের লক্ষ্যে জনগণের ম্যান্ডেট গ্রহণ করেন এবং ১৯৭০ সালের ৭ মার্চ ঐতিহাসিক ভাষণের মাধ্যমে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে তাঁর অনুপস্থিতিতে মুক্তিযুদ্ধে করণীয় ও অংশগ্রহণের নির্দেশনা প্রদান করেন।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী আকস্মিকভাবে বাংলাদেশের ভূখণ্ডে গণহত্যা চালায়, বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে।

গ্রেপ্তারের পূর্বক্ষণে ২৫ মার্চ রাতের শেষভাগে অর্থাত্ ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু তাঁর অনিশ্চিত জীবনের পরিণতি না ভেবে আজীবনের লালিত স্বপ্ন ও জাতির আকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্য বাংলাদেশের স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন। স্বাধীনতার এই ঘোষণা এবং ৭ মার্চের ভাষণের নির্দেশনা ও কৌশল অনুযায়ী সমগ্র বাঙালি জাতি একতাবদ্ধ হয়ে বঙ্গবন্ধুকে সর্বাধিনায়ক মেনে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বঙ্গবন্ধুকে বন্দি করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যায় এবং বাংলাদেশের ভূখণ্ডে আন্তর্জাতিক রীতিনীতি লঙ্ঘন করে নিরস্ত্র বাঙালি হত্যা, সম্পদ ধ্বংস ও নারীর অপমান প্রভৃতি পৈশাচিক কাজে লিপ্ত হয়। কিন্তু বাঙালি জাতি বঙ্গবন্ধুকে তাদের প্রেরণা ও নেতৃত্বের অধিকারী মেনে তাঁর ঘোষণা অনুযায়ী দেশের স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে অবিচল থাকে।

বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে একতাবদ্ধ জাতি স্বাধীনতা অর্জন করে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে মিত্র দেশ ভারত শরণার্থীদের আশ্রয়, মুক্তিবাহিনীকে প্রশিক্ষণ ও সরঞ্জাম এবং মুক্তিযুদ্ধে তাদের সেনা পাঠিয়ে উদার সহযোগিতা দেয়। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি সব ষড়যন্ত্র ও জল্পনাকল্পনার অবসান ঘটিয়ে মুক্ত বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করেন এবং স্বাধীনতা পূর্ণতা পায়। বঙ্গবন্ধু ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত, অসাম্প্রদায়িক, মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন গণতান্ত্রিক সোনার বাংলা গড়ার কাজে মনোনিবেশ করেন। এই লক্ষ্যে তিনি যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের অবকাঠামো মেরামত ও পুনর্নির্মাণ, ক্ষতিগ্রস্ত জনগণ ও শরণার্থীদের পুনর্বাসনের পাশাপাশি তিনি তাঁর সম্মোহনী নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র সমর্পণ, ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা অস্ত্র সংগ্রহ এবং দ্বিপক্ষীয় আস্থার সম্পর্ক অটুট রেখে মিত্র বাহিনীকে ১৯৭২ সালের ১২ মার্চ স্বীয় দেশ ভারতে প্রত্যাবর্তনের মতো গুরুত্বপূর্ণ স্পর্শকাতর কাজ অতি দ্রুততম সময়ে সম্পন্ন করেন, সব পর্যায়ে প্রশংসিত হয় এবং বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের একটি অনন্য সাহসী দিক জাতি ও বিশ্ব প্রত্যক্ষ করে।

বাংলাদেশের সাংবিধানিক ভিত্তি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার এক বছরের মধ্যে ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর জাতিকে একটি সংবিধান উপহার দেন, যার মূলনীতি ছিল গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদ। এত অল্প সময়ে একটি উত্তম সংবিধান রচনার ইতিহাস বিশ্বে বিরল। বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ দলিল সংবিধান প্রবর্তনের সমসাময়িক সময়ে ১৯৭৩ সালে সোনার বাংলা গঠন করার এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন কর্মসূচিসংবলিত আরেকটি দলিল প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা (১৯৭৩-১৯৭৮) জাতির সামনে উপস্থাপন করেন। বঙ্গবন্ধুর বলিষ্ঠ নেতৃত্ব এবং সময়োপযোগী আগ্রাসী আর্থিক কর্মসূচির ফলে যুদ্ধবিধস্ত দেশটির ১৯৭৪ সালে প্রবৃদ্ধির হার দাঁড়ায় ৭.৮ শতাংশ। তিনি দেশে একমুখী শিক্ষাব্যবস্থা চালুর মাধ্যমে শিক্ষিত ও প্রশিক্ষিত দক্ষ মানবসম্পদে রূপান্তর করে জনসংখ্যা যে সমস্যা নয় বরং সম্পদ, তা প্রমাণ করার জন্য উদ্যোগী ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। ১৯৭৩ সালে জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনে অংশগ্রহণ, ১৯৭৪ সালে পাকিস্তানের স্বীকৃতি অর্জন করে ওআইসি সম্মেলনে যোগদান এবং ১৯৭৪ সালে জাতিসংঘের অধিবেশনে বাংলায় ভাষণ দান প্রভৃতি কার্যক্রমের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু সোনার বাংলাকে আন্তর্জাতিক মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করেন। কিন্তু স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি, অতি বিপ্লবী ও প্রতিবিপ্লবীরা বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ার কাজে বাধা হয়ে দাঁড়ায় এবং দেশে এক অরাজকতা ও অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করে। এই পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু সোনার বাংলায় দারিদ্র্য বিমোচন, মানবিক মূল্যবোধ ও সামাজিক ন্যায়বিচার, সাম্য ও সম্পদের সুষম বণ্টন, গণতন্ত্র, অসাম্প্রদায়িকতা ও সুশাসন টেকসই করার লক্ষ্যে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, প্রশাসনিক ও গ্রামীণ কৃষি ব্যবস্থা সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহণ করেন এবং দ্বিতীয় বিপ্লবের ডাক দেন। বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লবের আহ্বানে পেশাজীবী, বুদ্ধিজীবী, কর্মজীবী তথা সমগ্র জাতি পুনরায় প্রথম বিপ্লব স্বাধীনতা অর্জনের মতো ঐক্যবদ্ধ হয়। জাতির এই ঐক্যে মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তি এবং তাদের আাান্তর্জাতিক দোসরদের ভিত্তিমূলে আঘাত করে। তারা এই ভেবে শঙ্কিত হয়, বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লব সফল হলে বাংলাদেশকে সোনার বাংলায় রূপান্তর ঠেকানো যাবে না। তাই তারা পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী বাংলাদেশকে অকার্যকর একটি সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র পরিণত করার সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হবে ভেবে সম্মিলিতভাবে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরিকল্পনা করে এবং ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে। এই হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে বাংলাদেশের পিছিয়ে পড়া শুরু হয়, পরনির্ভরশীলতার উন্মেষ ঘটে। 

বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার চেতনাবিরোধী সামরিক সরকার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করে, সংবিধান থেকে সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার মূলনীতি মুছে ফেলে, পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার উন্নয়নের ধারাবাহিকতা ব্যাহত হয়, স্বাধীনতার অমর স্লোগান ‘জয় বাংলা’ মুছে ফেলার চেষ্টা করা হয়। পাকিস্তানি কায়দায় ‘জিন্দাবাদ’ ধ্বনির রব উঠে আসে। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় সাম্প্রদায়িকতার উন্মেষ ঘটে, সাম্প্রদায়িক ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টি হয়, আদর্শিক রাজনৈতিক চর্চার বিচ্যুতি হয়, যুবসমাজকে নৈতিকতাবিরোধী বৈষয়িক কাজে যুক্ত হতে উত্সাহিত করা হয়। সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সংগঠনগুলো ক্ষমতাসীন সামরিক জান্তা সরকারের আজ্ঞাবহ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। মুক্তিযুদ্ধবিরোধীদের রাষ্ট্রীয় সহায়তায় পুনর্বাসিত করা হয়, দেশের রাজনীতি ও অর্থনীতিতে তাদের প্রভাব-প্রতিপত্তি নিশ্চিত করা হয়। যুদ্ধাপরাধী, মানবতাবিরোধীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে তাদের গাড়িতে জাতীয় পতাকা দিয়ে এবং নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে অবজ্ঞা করা হয়। দেশের অভ্যন্তরে অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার ও চোরাচালান চলতে থাকে। প্রতিযোগী রাজনৈতিক সংগঠন ও ব্যক্তিত্বকে নিশ্চিহ্ন করার প্রচেষ্টা করা হয়। সামরিক বাহিনীতে কৌশলে অসন্তোষ ও বিদ্রোহের সূচনা করে মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী কর্মকর্তা, সেনাদের একের পর এক হত্যা করা হয়, নেতৃত্বে অমুক্তিযোদ্ধাদের গুরুত্বপূর্ণ পদ ও মর্যাদায় আসীন করা হয়। ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন খুনির সুরক্ষা দেওয়া হয়, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অনৈতিক ব্যবহার করে খুনের মামলায় সাজাপ্রাপ্ত আসামিদের মুক্তি দেওয়া হয় এবং দেশের বিচারহীনতার অপসংস্কৃতি চালু করা হয়। দীর্ঘ ২১ বছর পর্যন্ত এই ধারা অব্যাহত থাকে। ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ার অসমাপ্ত কাজ শেষ করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। 

সংবিধান থেকে ইনডেমনিটি আদেশ বাতিল করে বঙ্গবন্ধুর খুনি এবং যুদ্ধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারকার্য শুরু করেন, নির্বাসিত গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনেন, ধর্মের উগ্রবাদ ও অপব্যবহার রোধ করে জাতিকে অসাম্প্রদায়িক চেতনায় ফিরিয়ে আনতে সচেষ্ট হন। সামরিক বাহিনীর শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনে ক্যু-হত্যার অবসান ঘটান। পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে জনগণকে সামাজিক সুরক্ষা বলয়ের আওতায় এনে দুর্ভিক্ষ, মন্দা প্রভৃতি দূর এবং অবকাঠামোগত উন্নয়নের মাধ্যমে বিদ্যুত্, কর্মসংস্থান ব্যবস্থা নিশ্চিত এবং বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে দেশকে মুক্ত করে সোনার বাংলা গঠনে উদ্যোগী হন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলদেশ আজ বিশ্বে উন্নয়নের রোল মডেল। উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রেখে বাংলাদেশকে সোনার বাংলায় রূপান্তরে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিকল্প একমাত্র দেশরত্ন শেখ হাসিনা। তাই বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার হাতকে শক্তিশালী করার মাধ্যমে ১৫ আগস্টে হত্যার শোককে শক্তিতে পরিণত করতে হবে। বাঙালি জাতিকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার কলঙ্কমোচনের উপায় খুঁজতে হবে এবং সেটি একমাত্র দেশরত্ন শেখ হাসিনার নেতৃত্বেই সম্ভব। 

লেখক : উপ-উপাচার্য, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়।

– দৈনিক পঞ্চগড় নিউজ ডেস্ক –