• শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ১৫ ১৪৩০

  • || ১৮ রমজান ১৪৪৫

সর্বশেষ:
বাংলাদেশকে হুমকির মুখে ফেলেছে ক্রমবর্ধমান জলরাশি: গবেষণা উত্তরবঙ্গের মহাসড়কে চার লেন চালু, ঈদযাত্রা হবে স্বস্তির সব উন্নয়ন সহযোগীদের এক প্ল্যাটফর্মে আসা প্রয়োজন: পরিবেশমন্ত্রী বিডিএস ভূমি ব্যবস্থাপনায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনবে: ভূমিমন্ত্রী বিএনপির নিগৃহীত নেতাকর্মীদের তালিকা দিতে হবে: ওবায়দুল কাদের

আন্তর্জাতিক পরিবার দিবস আজ

প্রকাশিত: ১৫ মে ২০২২  

১৫ মে, আন্তর্জাতিক পরিবার দিবস আজ। ১৯৯৩ সালের ২০ সেপ্টেম্বর রাষ্ট্রসংঘ সাধারণ পরিষদের এক সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১৫ মে আন্তর্জাতিক পরিবার দিবস হিসেবে ঘোষিত হয়। রাষ্ট্রসংঘ ১৯৯৪ সালকে আন্তর্জাতিক পরিবার বর্ষ ঘোষণা করেছিল। যৌথ পরিবারের ঐতিহ্য ধরে রাখার মানসিকতা সৃষ্টির লক্ষে দিবসটি পালিত হচ্ছে। পরিবার আত্মীক সম্পর্কের সূতিকাগার। পরিবারের সদস্যদের মধ্যে গড়ে ওঠে স্নেহ মমতা, ভালোবাসা সৌহার্দ এবং পারস্পারিক সম্পর্কের বন্ধন। 

সুপ্রাচীন কাল থেকে যে যৌথ পরিবারে চিত্র সারাবাংলা জুড়ে ছিল এখন তা অনেকটাই ম্লান। শহুরে জীবনে অনেক আগেই বিলীন হয়েছে যৌথ পরিবারের চিত্র। আগে গ্রামে কিছু যৌথ পরিবার দেখা গেলেও এখন তাও নেই। বংশ মর্যাদা এমনকি ঐতিহ্যের পরিবারেও বিলীন একত্রে বাস করার ইতিহাস। পরিবার মানেই হচ্ছে মা, বাবা, ভাই, বোন, দাদা, দাদি সবাইকে নিয়ে একসঙ্গে বসবাস।

আমাদের সমাজব্যবস্থায় পরিবারের এই ধারণা প্রচলিত অতীত থেকেই। তবে দিন যতোই যাচ্ছে, আমরা যেন ততোই এই ধারণা থেকে বেরিয়ে আসছি। যেন ক্রমেই স্বামী-স্ত্রী-সন্তানেই সীমাবদ্ধ করে ফেলছি আমরা পরিবারকে। সেখানে মা-বাবা কিংবা দাদা-দাদির কোনো স্থান নেই। মা-বাবাকে হয়তো গ্রামের বাড়িতে কাটাতে হচ্ছে নিঃসঙ্গ-অসহায় জীবন। আবার অনেক মা-বাবার ঠিকানা হচ্ছে বৃদ্ধাশ্রম। 

অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে একান্নবর্তী কিংবা যৌথ পরিবারের ধারণা যেন এখন সেকেলে হয়ে গেছে। বিশেষ করে, শহুরে জীবন ব্যবস্থায় এই ব্যাপারটি চরম আকার ধারণ করেছে। সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, আমাদের সমাজে প্রচলিত যৌথ পরিবারে পারস্পরিক সম্প্রীতি গভীর হয়, অটুট থাকে। অসুখ বিসুখসহ নানা সমস্যায় একে অন্যের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়। এতে অনেক বড় সমস্যাও সমাধান হয়ে যায় অতি সহজে। সময়ের তাগিদে যৌথ পরিবার কিংবা পারিবারিক বন্ধন অটুট রাখার বিষয়টি যখন এই সমাজে ক্রমান্বয়ে গুরুত্বহীন হয়ে উঠছে, ঠিক সেই মুহূর্তে আজকের এই আন্তর্জাতিক পরিবার দিবস পালনের গুরুত্ব অপরিসীম। 

রক্তের বন্ধন মানেই পারিবারিক বন্ধন। পরিবারের সব সদস্যের মধ্যে অকৃত্রিম সুসম্পর্ক গড়ে তোলা এবং তা অটুট রাখা আমাদের সবার নৈতিক দায়িত্ব। আমাদের চিরায়ত সমাজ ব্যবস্থায় সুন্দর জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত হচ্ছে, সুন্দর পারিবারিক বন্ধন। পরিবারের সব সদস্যের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক বন্ধুর মতো হলে পারিবারিক নানা জটিল সমস্যা ও মোকাবেলা করা যায়। সবার এগিয়ে চলার পথ হয় মসৃণ। মূলত এই প্রেক্ষাপটেই আজ বিশ্বে পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক পরিবার দিবস।

সমাজ বিজ্ঞানের প্রতিষ্ঠাতা বিজ্ঞানী এমিল ডুরমিখ পরিবার সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেছেন, পরিবার হচ্ছে একটি মানবিক সংগঠন, যেখানে মানুষ তার প্রাথমিক শিক্ষা লাভ কওর থাকে। সমাজ বিজ্ঞানী সামনার ও কেলারের মতে, পরিবার হলো ক্ষুদ্র সামাজিক সংগঠন-যা কমপক্ষে দুই পুরুষকাল পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে- এ সংজ্ঞার প্রেক্ষিতে বোঝা যায়, বিবাহ প্রথার আগেও সমাজে পরিবারের সৃষ্টি হয়েছিল, কারণ এ সম্পর্কে আবদ্ধ হওয়ার আগে থেকেই মানুষ দলবদ্ধ জীবনযাত্রা করত যা পারিবারিক জীবনযাপনের স্বাক্ষরবহ। নৃবিজ্ঞানী ম্যালিনোস্কির মতে – “পরিবার হলো একটি গোষ্ঠী বা সংগঠন আর বিবাহ হল সন্তান উৎপাদন ও পালনের একটি চুক্তি মাত্র”।

সামনার ও কেলারের মতে- ‘পরিবার হলো ক্ষুদ্র সামাজিক সংগঠন, যা কমপক্ষে দু’ পুরুষকাল পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে- এ সংজ্ঞার প্রেক্ষিতে বোঝা যায়, বিবাহপ্রথার আগেও সমাজে পরিবারের সৃষ্টি হয়েছিল, কারণ এ সম্পর্কে আবদ্ধ হওয়ার আগে থেকেই মানুষ দলবদ্ধ জীবনযাত্রা করত যা পারিবারিক জীবনযাপনের স্বাক্ষরবহ। তবে বিভিন্ন সমাজে বিভিন্ন সংস্কৃতির পরিবারের ভূমিকা ভিন্ন ভিন্ন ভাবে পরিলক্ষিত হয়। এর উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে বৈচিত্র্যপূর্ণ নানামুখী ধারা যে কারণে ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি পরিবর্তনের সঙ্গে এর গঠন ও অন্যান্য অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে এবং হচ্ছে। 

শিল্প বিপ্লবের পরে পরিবারের ধরন ও ভূমিকা পাল্টাতে থাকে। সামাজিক ও অর্থনৈতিক কারণে পিতৃতান্ত্রিক পারিবারিক ব্যবস্থা থেকে ক্রমশ ব্যক্তিকেন্দ্রিক গণতান্ত্রিক পরিবার বা যৌথ পরিবার ব্যবস্থা থেকে একক বা নিউক্লিয়ার পরিবার। সমাজবিজ্ঞানী ফলসমের মতে একক পরিবারের অন্যতম তিনটি কারণ যেমন স্ত্রী ও পুরুষ উভয়েরই প্রয়োজন ও চাহিদা সম্পর্কে সচেতনতা, অলাভজনক শিশুশ্রম এবং জন্ম নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে ব্যাপক প্রচার। এরই সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আর্থিক অনটন, ব্যক্তিত্বের সংঘাত এবং ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবাদের উন্মেষ।

আন্তর্জাতিক পরিবার দিবস পালন শুরু হয় ১৯৯৫ সাল থেকে। বিশেষ করে, শিল্প বিপ্লবের পর থেকে বিশ্বের পশ্চিমা উন্নত দেশ গুলোতে পরিবারের প্রতি অনাগ্রহ সৃষ্টির প্রক্রিয়া শুরু হয়। ভেঙে যেতে থাকে পরিবারের প্রচলিত বন্ধন। সেই সঙ্গে বাড়তে থাকে বিবাহ বিচ্ছেদসহ নানান সামাজিক সমস্যা। ফলে অনেক শিশুই বাবার পরিচয় ছাড়া বড় হতে থাকে। এই অবস্থায় পারিবারিক বন্ধন অটুট রাখতে জনসচেতনতা সৃষ্টির ওপর তাগিদ দেয় জাতিসংঘ। ১৯৯৩ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১৫ মে আন্তর্জাতিক পরিবার দিবস পালনের ঘোষণা দেয়া হয়। 

তাছাড়া, ১৯৯৫ সালে কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠিত ‘সামাজিক উন্নয়নের জন্য বিশ্ব’- শীর্ষক সম্মেলনে সামাজিক বন্ধনের ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। মূলত এই দিবস পালনের উদ্দেশ্য হচ্ছে পারিবারিক ছোট বড় সব সদস্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার মাধ্যমে পারস্পরিক সম্পর্ক অটুট রাখা। বিশেষ করে, শিশুদের মৌলিক চাহিদা পূরণ ও বড়দের প্রতি শ্রদ্ধাশীল মনোভাব পোষণ করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শহুরে সমাজে যৌথ পরিবারের ধারণা ফিকে হয়ে আসলেও গ্রামীণ সমাজে এখনও যৌথ পরিবারগুলো সুখে-শান্তিতে বসবাস করে আসছে। আর এটাই আমাদের ঐতিহ্য। 

পাশ্চাত্য সংস্কৃতি অনুসরণ করে যারা প্রত্যক্ষভাবে রক্তের সম্পর্ক অস্বীকার করে নিকটজনকে দূরে ঠেলে দিচ্ছে, তারা পরোক্ষভাবে আমাদের চিরাচরিত সমাজ-ব্যবস্থাকেই অস্বীকার করছে। তবে পরিবারের মৌলিক কাজ অনেক। এক দিকে জৈবিক, অপর দিকে মনস্তাত্ত্বিক, অর্থনৈতিক, শিক্ষাদান ইত্যাদি। তবে সব চেয়ে বড় দায়িত্ব শিশুর সামাজিকীকরণ এবং সংস্কৃতির সংরক্ষণ। যে শিশুটি ভবিষ্যতের নাগরিক, তার মনোজগত প্রস্তুত হয় পরিবারে। পরিবারের ধারা কেমন, কী ধরনের প্রথা-রীতিনীতি, এ সবের উপর ভিত্তি করে তার জীবনভঙ্গি গড়ে ওঠে। তাই শিশুর সুষ্ঠু পারিবারিক শিক্ষা শৈশব তথা শিশুর মন তথা সাদা কাগজের পাতায় যে ছাপ রাখে, তা ওর পরবর্তী জীবনে অসাধারণ ভূমিকা রাখে। 

তাই রাষ্ট্র পরিচালনায় যেমন কিছু সংবিধান আছে তেমনি পারিবারিক সংবিধানও থাকা দরকার। যেমন পরিবারের সবার সঙ্গে সদ্ভাব গড়ে তোলা, সাংসারিক শৃঙ্খলা বজায় রাখা, মিথ্যে না বলা, গুরুজনদের শ্রদ্ধা করা, নির্দিষ্ট সময়ে ঘরে ফেরা, নিজের কাজ নিজে সম্পন্ন করা, মিথ্যেকে ঘৃণা করা এবং মানবিক মূল্যবোধগুলোর চর্চার মাধ্যমে অন্তরকে বিকশিত করা। আমাদের জাতিগত একটি বৈশিষ্ট্য আছে, আছে নিজস্ব কৃষ্টি-সংস্কৃতি। এই সবকিছুকেই আমাদের ধারণ করে সামনে এগুতে হবে। আমাদের বুঝতে হবে, অন্যের কাছ থেকে ধার করা কোনো কিছুতেই গৌরব নেই। বরং তা আমাদের জন্য অপমান। 

সর্বোপরি, পারিবারিক বন্ধন ভেঙে যাচ্ছে বলেই আমাদের সামাজিক নানা সমস্যা দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। বাড়ছে অস্থিরতা। ধর্মীয় বিধানেও রক্তের সম্পর্ক অক্ষুন্ন রাখার ওপর তাগিদ দেয়া হয়েছে। ইসলামের দৃষ্টিতে পরিবার সমাজের ভিত্তিমূল।

আন্তর্জাতিক পরিবার দিবসে বিশ্বের প্রতিটি পরিবারের বন্ধন দৃঢ় হোক এবং পরিবারের প্রতিটি সদস্যের মধ্যে পারস্পরিক ভালোবাসা ও সৌহার্দ্য বৃদ্ধি পাক। 

– দৈনিক পঞ্চগড় নিউজ ডেস্ক –