• বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ১২ ১৪৩১

  • || ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫

সর্বশেষ:
যুদ্ধের অর্থ জলবায়ু পরিবর্তনে ব্যয় হলে বিশ্ব রক্ষা পেত- প্রধানমন্ত্রী দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদনের রেকর্ড মেডিকেল কলেজের ক্লাস অনলাইনে নেয়ার নির্দেশ স্বাস্থ্যমন্ত্রীর ‘গণতান্ত্রিক রীতিনীতি না মানলে জনগণই বিএনপিকে প্রতিহত করবে’ লালমনিরহাটে হত্যা মামলায় বিএনপির দুই নেতা কারাগারে

চালকবিহীন লঞ্চ দেখতে ভিড়

প্রকাশিত: ১৬ আগস্ট ২০২২  

জীবিকার তাগিদে একসময় বরিশালে থাকতো যুবক নুর নবী ইসলাম। বরিশাল যাওয়ার মাধ্যম ছিল লঞ্চে। ঢাকা থেকে বরিশাল আসা-যাওয়ার পথে লঞ্চ দেখে অবাক হতেন যুবক নুর নবী। সেখানে কিছু দিন কাজ করার পর বাড়ি ফিরে আসেন তিনি। পরে বাড়ির পাশের একটি বাজারে গড়ে তোলেন মোবাইল সার্ভিসিংয়ের দোকান। তবে বাড়ি ফিরে ভিন্ন পেশায় যুক্ত থাকলেও তার মনে কৌতুহল জাগে লঞ্চ তৈরি করবেন তিনি। 

সেই স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে গত ৩ মাস আগে লঞ্চ তৈরির পরিকল্পনা গ্রহণ করেন নূর নবী। সদরঘাটে দেখা লঞ্চ দেখে তার আদলে দীর্ঘ তিন মাসের প্রচেষ্টায় আস্ত একটি বহুতল লঞ্চ বানিয়ে এলাকায় তাক লাগিয়ে দিয়েছেন তিনি। পেশায় তিনি একজন মোবাইল সার্ভিসিং মেকার। 

নূর নবীর সেই আবিষ্কার করা লঞ্চ তৈরি এলাকায় রীতিমতো হৈচৈ ফেলেছে। তার লঞ্চটি একটিবার সামনে থেকে দেখার জন্য তার বাড়িতে  প্রতিদিন ভিড় জমাচ্ছেন বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা নানা বয়সী মানুষ। তার এমন লঞ্চ তৈরির খবর শুনে তার বাড়িতে  ভিড় করছেন স্কুল কলেজের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরাও।

নূর নবী ইসলাম পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জ উপজেলার সুন্দরদিঘী ইউপির চরপাড়া গ্রামে। নূর নবী ইসলাম ওই গ্রামের মৃত এমতাজ আলীর ছেলে।  

জানা গেছে, নূর নবী ছোট থেকে অনেক মেধাবী থাকলেও পড়েছেন মাত্র পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত। দরিদ্রতার কারণে একাডেমিক শিক্ষা থেকে ছিটকে পড়েন লেখাপড়ার আলো থেকে। ফলে মাধ্যমিকের আঙিনায় যেতে পারেননি। জীবিকার তাগিদে নূর নবী দীর্ঘ দিন ধরে দেশের বিভিন্ন জেলায় ইলেক্ট্রনিক্সের কাজ করেন।  

সর্বশেষ তিনি বরিশালে ৬ মাস কাজ করেন। বরিশালে থাকা অবস্থায় সেখান থেকে বাড়ি আসা -যাওয়ার পথে আশ্চর্য হয়ে যেতেন বহুতল লঞ্চ দেখে। লঞ্চে উঠলেই তিনি পুরো লঞ্চ ঘুরে বেড়াতেন। কিভাবে এমন একটা লঞ্চ বানাতে পারবেন এমনই ছিল তার স্বপ্ন। 

গত ৫ বছর আগে তিনি বাড়িতে ফিরে আসেন এবং মোবাইল সার্ভিসিংয়ের কাজের পাশাপাশি লঞ্চ তৈরির বিষয়ে ইউটিউবসহ নিজ চোখে দেখা লঞ্চের বিভিন্ন  অংশ মনে করতে থাকেন এবং বিভিন্ন জিনিসপত্র সংগ্রহ করেন। পরে গত ৩ মাস আগে তিনি শুরু করেন তার লঞ্চ তৈরির কাজ। লঞ্চ তৈরির উপকরণ হিসেবে তিনি মোটর, ককসিট, লাইটিং ও ব্যাটারি ব্যবহার করেন। 

নিজের মেধা খাটিয়ে তিন মাসের মধ্যে বানিয়ে ফেলেন আস্ত এক বহুতল লঞ্চ। লঞ্চটি তৈরি করতে ব্যবহার করেছেন ককসিট, ব্যাটারি চালিত মোটর, মোবাইলের ব্যাটারি, ম্যাজিক লাইট এবং গাম। দিয়েছেন আলোকসজ্জা ও মিউজিক বাতি। অভ্যন্তরে রেখেছেন মাস্টার কেবিন, যাত্রী কেবিন। এ লঞ্চ তৈরি করতে তার খরচ হয়েছে ১২ থেকে ১৩ হাজার টাকা। সময় লেগেছে তিন মাসের মতো।  তিনি তার লঞ্চটির নাম দিয়েছেন ‘মেসার্স পাভেল শিপিং লাইন্স’। 

যদিও নূর নবীর নিখুঁত হাতের তৈরি বহুতল ভবনের লঞ্চটি খেলনা হিসেবে তৈরি করা হয়েছে। তবে লঞ্চটির স্থাপত্য দেখে অবাক হয়ে যাচ্ছেন অনেকেই।  সদরঘাটে যে লঞ্চ নদীতে চলে সেই লঞ্চের মতো দেখতে শুধু পার্থক্য ছোট -বড়। নূর নবীর আবিষ্কার করা এই লঞ্চ চলে চার্জের মাধ্যমে। শুধু তাই নয় তার লঞ্চটি চলে চালকবিহীন। চলে রিমোটের মাধ্যমে। বাইরে থেকে কোনো মানুষ দেখতে আসলেই যুবক নূর নবীর বাড়ির পাশে সুন্দর দিঘীর স্কুলের পাশে পুকুরে চালিয়ে দেখান তার ব্যাটারি চালিত লঞ্চটি। 

রিমোর্ট কন্ট্রোলে লঞ্চটি ঘুরে ঘুরে নুর নবীর ফেরিতে এসে থামছে। তা দেখতে ভিড় জমাতে দেখা যায় দর্শনার্থীদের। তার লঞ্চের টার্মিনাল, উঠানামার সেতুও রয়েছে। দিনের চেয়ে রাতে সেই পুকুরে লঞ্চটি চললে দূর থেকে যে কারো মনে হতে পারে দূর থেকে কোন লঞ্চ আসতেছে ঘাটের দিকে। এদিকে নূর নবীর স্বপ্ন তার লঞ্চটি তিনি চালাক ছাড়াই যেন প্রযুক্তি ব্যবহার করে কন্ট্রোল রুম থেকে চালানো যায় সেই বিষয়ে কাজ করছেন। 

এদিকে লঞ্চ তৈরির খবর ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়লে বিভিন্ন এলাকা থেকে মানুষ ছুটে আসছেন লঞ্চটি দেখার জন্য। উপভোগ করছেন পুকুরের লঞ্চ চলার দৃশ্য।  দর্শনার্থীরা বলছেন, এরকম প্রত্যন্ত অঞ্চলে এমন মেধাবী যুবক রয়েছে জানা ছিল না। যে কীনা অভিজ্ঞতা ছাড়াই লঞ্চ বানাতে পারে।

এদিকে চড়পাড়া এলাকার বাসিন্দা ও নূর নবীর প্রতিবেশী বদিউজ্জামাল বলেন, আমরা খুব আনন্দিত গর্ববোধ করছি। আমাদের এ প্রত্যন্ত অঞ্চলে  নূর নবী নিজের মেধা খাটিয়ে একটি লঞ্চ তৈরি করেছেন। আমরা সদরঘাটে যে লঞ্চ দেখছি ঠিক সেই লঞ্চের মতো দেখতেই নূর নবীর লঞ্চটি। তাই সরকারের কাছে দাবি জানাই আমরা এলাকাবাসী, নূর নবীকে যেন সরকার আর্থিকভাবে সহযোগিতা করে তাহলে সে আরো নতুন নতুন আবিষ্কার  করতে পারবে। 

নূর নবীর প্রতিবেশী আছিয়া খাতুন বলেন, নূর নবী ছোট থেকে বিভিন্ন জিনিসপত্র নিজে খুলে আবার ঠিকঠাক করতো। সে যে এত সুন্দর করে লঞ্চ তৈরি করে পানিতে চালিয়ে দেখাবে এটা কল্পনাও করিনি। আমরা কোনো দিন লঞ্চ দেখিনি, নূর নবীর লঞ্চ দেখে জীবনের প্রথম বারের মতো লঞ্চ দেখলাম। 

এ বিষয়ে কথা হয় নীলফামারী থেকে লঞ্চ দেখতে আসা শহিদুল ইসলাম নামে এক দর্শনাথীর সঙ্গে। তিনি বলেন, আমার জীবনে স্ব-চোখে কোনো দিন লঞ্চ দেখিনি। ফেসবুকের মাধ্যমে জানতে পারলাম নূর নবী লঞ্চ তৈরি করছেন। সেটি দেখতে বন্ধুদের সঙ্গে আসলাম নূর নবীর বাড়িতে। দেখে অনেক ভাল লাগলো। 

লঞ্চের নির্মাতা নূর নবী ইসলাম বলেন, ‘বরিশালে যখন কাজ করতে গেছিলাম তখন সদরঘাট থেকে বরিশাল লঞ্চে যাতায়াত করতাম। তখন থেকেই ইচ্ছে পোষণ করি  লঞ্চ তৈরি করব। দীর্ঘ দিন উপকরণ ও গবেষণা করে চালকবিহীন ও ব্যাটারি চালিত লঞ্চটি তৈরি করি। লঞ্চটি রিমোট কন্ট্রোলের মাধ্যমে চলে। যদিও এটা খেলনা হিসেবে তৈরি করেছি। এখন দেখছি এটা দেখতে প্রচুর লোকজন ভিড় করছেন। ভালো লাগছে, আরো উদ্বুদ্ধ হচ্ছি। আমার তো আর্থিক অবস্থা ভালো নয়। অর্থ হলে আরো ভালো কিছু করতে পারবো। তাই সরকারিভাবে কোনো সহযোগীতা পেলে নতুন করে আবিষ্কার করতে পারবো।

এদিকে সুন্দর দিঘী ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল হালিম বলেন, নূর নবীর মতো ছেলে রীতিমতো লঞ্চ তৈরি করে দেখিয়ে দিয়েছে আমাদের ছেলেরা অনেক কিছুই করতে পারে। নূর নবীর যদি মেধার মূল্যায়ন করা হয় এবং অর্থ দিয়ে সহযোগীতা করা হয় তাহলে সে নতুন নতুন আবিষ্কার দেখাতে পারবে৷

– দৈনিক পঞ্চগড় নিউজ ডেস্ক –