• বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ১৪ ১৪৩০

  • || ১৭ রমজান ১৪৪৫

করোনাভাইরাস আতঙ্কের মাঝে আরেক আতঙ্কের নাম মশা!   

প্রকাশিত: ১৯ মার্চ ২০২০  

করোনাভাইরাস আতঙ্কের মাঝে রাজধানীবাসীর জন্য আরেক আতঙ্কের নাম মশা। শীত মৌসুম শেষ হওয়ার শুরুতেই ঢাকার দুই সিটিতে বেড়েছে মশার উপদ্রব। রাস্তাঘাট, বাসাবাড়ি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালত সর্বত্রই এখন মশার দৌরাত্ম্য। মশা নিধনে এখনই কার্যকর ব্যবস্থা না নিলে গত বছরের মতো ডেঙ্গুর ভয়াবহতা ছাড়িয়ে পড়তে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

এর আগে ২০১৯ সালে দেশে রেকর্ড সংখ্যক এক লাখ এক হাজার ৩৫৪ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী হাসপাতালে ভর্তি হন। সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) ওই বছর ২৭৬টি ডেঙ্গুজনিত মৃত্যুর প্রতিবেদন পায়।

ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন (ডিএনসিসি) সূত্র জানায়, চলতি অর্থবছরে ডিএনসিসির মশক নিধন খাতে বরাদ্দ ৪৯ কোটি ৩০ লাখ টাকা। লোকবল রয়েছে ২৭০ জন। নতুন করে ৫৪টি ওয়ার্ডে ১০ জন করে জনবল নিয়োগ দেয়া হয়েছে। নতুন আধুনিক মানের ২৩৮টি ফগার মেশিন, ২০টি মিক্সড ব্লোয়ারসহ বেশকিছু সরঞ্জামাদি ক্রয় করা হয়েছে।

এছাড়া একজন কীটতত্ত্ববিদকে প্রধান করে ১০ জন শিক্ষানবিশ কীটতত্ত্ববিদের সমন্বয়ে গঠিত একটি টিমের মাধ্যমে ডিএনসিসি নিজ এলাকায় জরিপ পরিচালনা করেছে। জরিপ অনুযায়ী, ডিএনসিসির ৫৪টি ওয়ার্ডের ৫৪০টি স্থানে ৬২০টি কিউলেক্স মশা প্রজননের হটস্পট রয়েছে। সেসব হটস্পটসহ ডিএনসিসি এলাকার সার্বিক পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রমে বিশেষ জোরদার করেছে।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম থেকে জানানো হয়, চলতি বছরে এখন পর্যন্ত ২৬০ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। তাদের মধ্যে ২৫০ জন চিকিৎসা শেষে হাসপাতাল ছেড়েছেন। শুক্রবার সকালে নতুন কোনো ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি না হলেও বৃহস্পতিবার নতুন করে পাঁচজন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হন।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন (ডিএসসিসি) সূত্র জানায়, মশক নিয়ন্ত্রণে ডিএসসিসিতে ৪০০ জন জনবল রয়েছে। নতুন করে ৭৫টি ওয়ার্ডে ১০ জন করে নিয়োগের কার্যক্রম চলছে। এছাড়া নতুন করে ২৫০টি ফগার মেশিন ক্রয় করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরের বাজেটে ডিএসসিসির মশক নিধন খাতে বরাদ্দ ৪৩ কোটি ৩০ লাখ টাকা।

এদিকে গত বছরের অভিজ্ঞতায় চিকুনগুনিয়া বা ডেঙ্গুসহ মশাবাহিত রোগের শঙ্কায় রয়েছে নগরবাসী। হাজারীবাগ, মোহম্মদপুর, পুরান ঢাকা, মগবাজার, মুগদা, বাড্ডা, কাফরুল, মিরপুর এলাকাসহ রাজধানী ঘুরে দেখা যায়, মশার অত্যাচারে নগরবাসীর অভিযোগ সিটি কর্পোরেশনের দিকে। অনেকেরই দাবি, সিটি কর্পোরেশন মশা নিয়ে আলোচনাসভা ছাড়া মাঠে ওষুধ ছিটাতে দেখেছি কম। তাছাড়া অপরিচ্ছন্ন বাড়িওয়ালাদের বিরুদ্ধে মামলা দিতে দেখিনি কখনো।

পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা’র) চেয়ারম্যান আবু নাসের খান বলেন, অপরিচ্ছন্ন পরিবেশের কারণে মশার প্রজনন বাড়ে। এজন্য সিটি কর্পোরেশন ও নগরবাসী উভয়কেই সচেতন হতে হবে এবং সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করতে হবে। আগামী দুই মাসের মধ্যে দুই সিটি কর্পোরেশন মশা নিয়ন্ত্রণে টেকসই কার্যক্রম বাস্তবায়ন করতে পারলে মশাবাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হবে। নইলে এবার গত বছরের চেয়ে চরম মূল্য দিতে হতে পারে।

এদিকে স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাম্প্রতিক এক জরিপে উদ্বেগজনক চিত্র উঠে এসেছে। জরিপে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের (ডিএসসিসি) ১২ শতাংশ এবং ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) ১০ শতাংশ এলাকায় এডিস লার্ভার ঝুঁকিপূর্ণ উপস্থিতির চিত্র উঠে এসেছে।
এতে দেখা যায়, দক্ষিণ সিটির ৫নং ওয়ার্ডের মুগদা, ৬নং ওয়ার্ডের মায়াকানন, ১১নং ওয়ার্ডের শাহজাহানপুর ও ১৭নং ওয়ার্ডের কলাবাগান এলাকা এবং উত্তর সিটির ১নং ওয়ার্ডের উত্তরা ৪নং সেক্টর, ১৬নং ওয়ার্ডের কাফরুল, ২৮নং ওয়ার্ডের পশ্চিম আগারগাঁও এবং ৩১নং ওয়ার্ডের নূরজাহান রোড এলাকায় এডিস মশার লার্ভার ঘনত্ব সূচক ইনডেক্স ২০ পয়েন্টের বেশি মিলেছে।

দক্ষিণের ৩৭নং ওয়ার্ডের বাংলাবাজার এলাকায় ঘনত্ব সূচক ইনডেক্স ৭০ এবং ৪২নং ওয়ার্ডের লক্ষ্মীবাজার এলাকার ইনডেক্স ৫০ পাওয়া গেছে। অন্যদিকে উত্তরের ১২নং ওয়ার্ডের তোলারবাগ এলাকায় এই সূচক ৩০ পয়েন্ট।

মশার লার্ভার উপস্থিতির হিসাব করা হয় এই ইনডেক্সের মাধ্যমে। প্রতি একশ’ প্রজনন উৎসের মধ্যে ২০ বা তার বেশিতে যদি এডিস মশার লার্ভা পাওয়া যায়, তাহলে সেটিকে ঝুঁকিপূর্ণ উপস্থিতি বলা হয় বলে জরিপে উল্লেখ করা হয়।

সংশ্লিষ্টদের তথ্য মতে, মূল রাজধানীর ১৩৪ বর্গকিলোমিটার এলাকার মধ্যে প্রায় ৬ বর্গকিলোমিটার জলাশয় রয়েছে। ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন, ঢাকা ওয়াসা, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড, পানি উন্নয়ন বোর্ডসহ বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা এসব জলাশয়ের মালিক।

সিটি কর্পোরেশনসহ সব সংস্থার নিজ নিজ জলাশয় পরিষ্কার করার দায়িত্ব থাকলেও কোনো সংস্থা তা করে না। এবার এসব জলাশয় পরিষ্কারে দুই সিটি কর্পোরেশনের স্বল্পপরিসরে তৎপরতা লক্ষ্য করা গেছে। একই চিত্র অন্তত ৩০০ কিলোমিটার কার্পেটিং ড্রেনের ক্ষেত্রেও।
এসব কার্পেটিং ড্রেনে মশা নিয়ন্ত্রণে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার পাশাপাশি ওষুধ ছিটানোর কার্যক্রমও পরিচালনা করতে পারছে না দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলো। পর্যায়ক্রমে কার্পেটিং ড্রেনগুলো উন্মুক্ত করার বিষয়ে সেবা সংস্থাগুলোর মধ্যে তেমন কোন উদ্যোগ নেই। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পর্যাপ্ত বরাদ্দ রাখা হলেও মশা নিয়ন্ত্রণে এই দুই সংস্থার তেমন কোনো সাফল্য লক্ষ্য করা যাচ্ছে না।

এ বিষয়ে ডিএসসিসির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডা. শরীফ আহমেদ জানান, মশার উপদ্রব নিয়ন্ত্রণে আমরা নিরলসভাবে কাজ করছি। জনসচেতনতা সৃষ্টির পাশাপাশি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, মশার লার্ভা নিধনসহ নানাবিধ কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। তিনি আরো বলেন, এ কাজ শুধু সিটি কর্পোরেশনের একার পক্ষে করা সম্ভব না। এজন্য নগরবাসীকে সচেতন হতে হবে। মশার প্রজনন বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখতে হবে।

অন্যদিকে ডিএসসিসির প্যানেল মেয়র জামাল মোস্তফা বলেন, এলাকাভিত্তিক মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম জোরদার করা হয়েছে। এসব কাজে জনগণকে সম্পৃক্ত করা হচ্ছে। নগরবাসী ও প্রতিষ্ঠান বা বাড়ির মালিকদের মশা নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখতে হবে। এজন্য ওষুধ ছিটানোর পাশাপাশি জনসচেতনতা বৃদ্ধিতেও নানা পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। কেননা প্রতিটি বাড়ির পেছনের চিপা-চাপা, ছাদ, জানালার সানসেট, এসব জায়গায় সিটি কর্পোরেশনের যাওয়া সম্ভব হয় না। আর অপরিচ্ছন্ন এসব জায়গায় মশার প্রজনন বাড়ছে।

তিনি আরো বলেন, আমরা ডোবা-নালা, ড্রেন, পরিষ্কার করছি এবং ওষুধ ছিটাচ্ছি। মানুষের বাড়ি পরিষ্কার করা তো আমাদের সম্ভব না। তাই সচেতনতা বৃদ্ধির উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এরপর কাজ না হলে অপরিচ্ছন্ন বাড়ি বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা দেয়া হবে।

– দৈনিক পঞ্চগড় নিউজ ডেস্ক –