• শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ১৪ ১৪৩০

  • || ১৮ রমজান ১৪৪৫

অধিকার আদায়ের পথ দেখিয়েছেন বঙ্গবন্ধু

প্রকাশিত: ১৭ আগস্ট ২০২১  

ড. বিমান চন্দ্র বড়ুয়া 

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের এই দিনে বঙ্গবন্ধুসহ তাঁর সহধর্মিণী মহীয়সী নারী বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব, একমাত্র ভাই শেখ আবু নাসের, বঙ্গবন্ধুর পুত্র শেখ কামাল, শেখ জামাল, ১০ বছরের শিশুপুত্র শেখ রাসেল, নবপরিণীতা পুত্রবধূ সুলতানা কামাল ও রোজী জামাল, বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান শেখ ফজলুল হক মনি (ভাগ্নে) ও তাঁর সন্তানসম্ভবা স্ত্রী বেগম আরজু মনি, বঙ্গবন্ধুর ভগ্নিপতি আব্দুুর রব সেরনিয়াবাত ও মেয়ে বেবী সেরনিয়াবাত এবং পুত্র আরিফ সেরনিয়াবত, দৌহিত্র সুকান্ত, ভাইয়ের ছেলে শহীদ সেরনিয়াবাত, আব্দুল নঈম খান রিন্টু, বঙ্গবন্ধুর প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা কর্নেল জামিলসহ অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারীকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। বঙ্গবন্ধুকন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা ওই সময় দেশের বাইরে থাকায় প্রাণে বেঁচে যান।

১৯৪৭ সালে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তানের সৃষ্টি করা হলে এ দেশের মানুষ ও ভূখণ্ডকে পাকিস্তানের অধীন করা হয়। পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ক্রমাগত এ দেশের অসহায় মানুষের ওপর শাসন, শোষণ, নির্যাতন, নিপীড়ন ও অত্যাচার চালায়। বঙ্গবন্ধু নির্যাতিত, বঞ্চিত, শোষিত পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ এ দেশের সর্বস্তরের মানুষকে স্বাধীনতা অর্জনের আকাঙ্ক্ষায় উজ্জীবিত করেন। ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি ছাত্রলীগের জন্ম, ছাত্রলীগের ১০ দফা দাবি, ’৪৮-এর মার্চ মাসে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা ঘোষণার প্রতিবাদে আন্দোলন, ’৪৯-এর ২৩ জুন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের জন্ম, ’৫২ সালের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, ’৫৪-এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ’৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, ’৬৩-এর জাতীয় গণতান্ত্রিক আন্দোলন, ’৬৬-এর ছয় দফা, ’৬৮-এর আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা ও ১১ দফা, ’৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান, ’৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয়সহ বৈপ্লবিক ইতিহাস সৃষ্টিকারী নানা ঘটনার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে এ দেশের মানুষ স্বাধীনতা অর্জনের দিকে দৃপ্ত শপথে এগিয়ে যায়।

বঙ্গবন্ধু একজন মানুষ হিসেবে সমগ্র মানবজাতিকে নিয়েই ভাবতেন। তাঁর প্রতি সবার আস্থা, গভীর ভালোবাসা ও শ্রদ্ধাবোধই তাঁকে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে সহায়তা করে। তিনি নিজের জীবন ও পরিবারের কথা বিন্দুমাত্র না ভেবে উদারতা, অসাম্প্রদায়িকতা, অপরিমেয় সাহস আর সততার মাধ্যমে এ দেশের মানুষকে সব ধরনের পাকিস্তানি শাসন-শোষণের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করেন। বলা বাহুল্য, তেজোদীপ্ত দৃঢ়প্রত্যয়, অমিত সাহস, আত্মত্যাগের মানসিকতা, প্রজ্ঞাময় দূরদৃষ্টি, অদম্য স্পৃহা ও বীরত্বের প্রবাহধারায় বঙ্গবন্ধু পুরো জাতিকে সুসংগঠিত ও ঐক্যবদ্ধ করে স্বাধীনতাসংগ্রামের পথকে বেগবান করেন। তিনি অব্যাহত এবং ধারাবাহিক আন্দোলন ও সংগ্রামের মাধ্যমে সবাইকে স্বাধীনতা লাভের বীজমন্ত্রে উদ্বুদ্ধ করে তোলেন। তিনি হয়ে ওঠেন অবিসংবাদিত নেতা। নেতৃত্ব দিতে গিয়ে তাঁকে সীমাহীন অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছে। মৃত্যুর মুখোমুখি হতে হয়েছে বহুবার। এ দেশের মানুষের অধিকার আদায় করতে গিয়ে তাঁর জীবনের বেশির ভাগ সময় তিনি কারাগারে অতিবাহিত করেন।

বঙ্গবন্ধু ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ বিনির্মাণের স্বপ্ন দেখেছিলেন এবং তা বাস্তবায়ন করেন। তাঁর প্রজ্ঞাময় রাজনৈতিক নেতৃত্বে প্রথমবারের মতো এ দেশের হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিস্টানসহ সর্বস্তরের মানুষ একত্র হয়ে অখণ্ড বাঙালি জাতিতে পরিণত হয়। তাঁর নেতৃত্বেই শুরু হয় ব্যাপক উন্নয়ন। স্বাধীনতাকে অর্থবহ করে তোলার জন্য তিনি অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষাসহ কর্মক্ষেত্র সৃষ্টির লক্ষ্যে বিভিন্ন কর্মসূচি দিয়ে জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা করেন, যেটা আগে কখনোই দেখা যায়নি।

সদ্যঃস্বাধীন বাংলাদেশ। দেশকে পুনর্গঠন করা এবং দেশের মানুষের কল্যাণ সাধন করা বঙ্গবন্ধুর প্রধানতম লক্ষ্য। তাই তিনি দৃঢ়তা আর আত্মমনোবল নিয়ে নিরলসভাবে পরিশ্রম করে উন্নয়নের ধারাকে সমুন্নত রেখে সমৃদ্ধির পথে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে থাকেন। তাঁর বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর, দেশপ্রেম আর উন্নয়নের প্রবহমান ধারা বন্ধ করার জন্য স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তি সপরিবারে তাঁকে হত্যা করে। পাকিস্তানসহ দেশি-বিদেশি দেশবিরোধী শত্রুরা এই হত্যাকাণ্ডকে স্বাগত জানায়। ষড়যন্ত্রকারীরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার মধ্য দিয়ে তাঁর নাম সর্বস্তরের মানুষের মন থেকে চিরদিনের জন্য মুছে দিতে সক্ষম হয়েছে কি? না। তা কখনো সম্ভব নয়। তিনি আমাদের সবার চালিকাশক্তি। সংগ্রামের পথপ্রদর্শক। সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা। সরদার ফজলুল করিম বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা প্রসঙ্গে বলেন : ‘শেখ মুজিবকে আমরা হত্যা করেছি আমাদের অতিক্রম করে বড় হওয়াতে। সব দিকে বড়, তেজে, সাহসে, স্নেহে, ভালোবাসায় আর দুর্বলতায়। ...এবং সেই ঈর্ষা থেকেই আমরা তাঁকে হত্যা করেছি। কেবল এই কথাটি বুঝিনি যে ঈর্ষায় পীড়িত হয়ে কারো স্থান দখল করা যায় না। তাই তো এই ভুখণ্ডে মুজিবের অবস্থান শীর্ষে।’

বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা নিছক কোনো একটি সাধারণ হত্যাকাণ্ড ছিল না। এটি ছিল সুদূরপ্রসারী ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। এই হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর লালিত স্বপ্নের সদ্যঃস্বাধীন সার্বভৌম লাল-সবুজের পতাকায় অঙ্কিত বাংলাদেশের অগ্রযাত্রাকে চিরতরে বন্ধ করে দেওয়ার ষড়যন্ত্র ছিল। শুধু তা-ই নয়, এটি বঙ্গবন্ধুর সব ধরনের ইতিহাস-ঐতিহ্য এবং পারিবারিক বংশ নির্মূল করার ষড়যন্ত্রও ছিল। বঙ্গবন্ধুকে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি ও পাকিস্তানপ্রেমিক কুচক্রী মহল হত্যা করে সর্বস্তরের মানুষের মন থেকে নামটি মুছে ফেলে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু তা সম্ভব হয়নি। তিনি ক্ষণজন্মা মহান ব্যক্তি হিসেবে মানুষের মনকে জয় করে হৃদয়াসনে স্থান করে নিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুকে নৃশংসভাবে হত্যা করার মধ্য দিয়ে একটি জাতিকে দিশাহারা করল। এমনকি এই হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকে ভূলুণ্ঠিত করল। তারা মনে করেছিল বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করলেই সব শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু না, তা মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। বঙ্গবন্ধুই মানেই বাংলাদেশ।

বঙ্গবন্ধু, বাংলাদেশ এবং স্বাধীনতা সমার্থক। পরস্পর অবিচ্ছেদ্য ও অভিন্ন সত্তা। বাংলাদেশ মানেই বঙ্গবন্ধু। স্বাধীনতা মানেই বঙ্গবন্ধু। একজন পরোপকারী, আত্মত্যাগী, সংগ্রামী ও দেশপ্রেমিক নেতা হিসেবে তিনি নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছেন। তাঁর জন্ম না হলে আজও আমরা পরাধীনই থাকতাম। তিনি আমাদের অধিকার আদায়ের পথ দেখিয়েছেন। শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস জুগিয়েছেন। মানুষের পাশে দাঁড়ানো এবং মানুষকে সেবা করতে উদ্বুদ্ধ করেছেন। তাঁকে কখনো ভুলে যাওয়ার নয়। তিনি স্মরণীয়, বরণীয় এবং শ্রদ্ধাভাজনীয়। বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতির উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক, যিনি আমাদের এনে দিয়েছেন আত্মপরিচয়ের গৌরব।

বঙ্গবন্ধু ক্ষুধা, দারিদ্র্যমুক্ত, বৈষম্যহীন সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ বিনির্মাণ করতে চেয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ার যে স্বপ্ন দেখেছিলেন, তাঁর সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সৎ, যোগ্য, বলিষ্ঠ ও দূরদর্শী নেতৃত্বে বিশ্বদরবারে বাংলাদেশ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। বিশ্বের মধ্যে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বিশ্ববাসীর কাছে বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে পরিচিত। সব ধরনের ষড়যন্ত্র ও প্রতিকূলতাকে অতিক্রম করে বঙ্গবন্ধুর সুচিন্তিত ও আদর্শিক ধারায় স্নাত হয়ে মমতাময়ী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর মেধা, সততা, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন রাজনৈতিক প্রজ্ঞার মাধ্যমে জনসাধারণের ভাগ্য পরিবর্তন করে দিয়েছেন। তিনি তাঁর পিতা বঙ্গবন্ধুর মতো সাহসী কণ্ঠে বলেন, ’পিতার মতো আমাকেও যদি জীবন উৎসর্গ করতে হয়, তা-ও করতে আমি প্রস্তুত।’ বহুমাত্রিক উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক শেখ হাসিনা আমাদের আশার বাতিঘর। বর্তমানে তাঁর নেতৃত্বেই এগিয়ে যাচ্ছে আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ।

লেখক : অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, কার্যনির্বাহী সদস্য, বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ, সদস্য-সম্প্রীতি বাংলাদেশ
 

– দৈনিক পঞ্চগড় নিউজ ডেস্ক –