• শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ১৫ ১৪৩০

  • || ১৮ রমজান ১৪৪৫

সর্বশেষ:
বাংলাদেশকে হুমকির মুখে ফেলেছে ক্রমবর্ধমান জলরাশি: গবেষণা উত্তরবঙ্গের মহাসড়কে চার লেন চালু, ঈদযাত্রা হবে স্বস্তির সব উন্নয়ন সহযোগীদের এক প্ল্যাটফর্মে আসা প্রয়োজন: পরিবেশমন্ত্রী বিডিএস ভূমি ব্যবস্থাপনায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনবে: ভূমিমন্ত্রী বিএনপির নিগৃহীত নেতাকর্মীদের তালিকা দিতে হবে: ওবায়দুল কাদের

করোনাকালে শিক্ষার্থীদের সমস্যা সমাধানে অভিভাবকদের করণীয়

প্রকাশিত: ১৮ আগস্ট ২০২১  

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল কাজী শামীম ফরহাদ, এনডিসি, পিএসসি  

মার্চ ২০২০ থেকে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। দীর্ঘ সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় ঘরে আবদ্ধ থাকার কারণে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে বেশ কিছু মনোদৈহিক সমস্যা তৈরি হয়েছে। অভিভাবকরা প্রায়ই তাঁদের সন্তানদের বিভিন্ন শারীরিক ও মানসিক সমস্যা নিয়ে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তাঁদের উৎসাহ ও অনুপ্রেরণায় আজকের এই লেখা। করোনা মহামারির এই দুর্যোগময় সময়ে দীর্ঘ সময় বাসায় অবস্থানজনিত কারণে আমাদের শিশু-কিশোররা যেসব শারীরিক ও মানসিক সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে, সে বিষয়ে আলোকপাত করার পাশাপাশি আমাদের অভিভাবকদের তাঁদের সন্তানদের জন্য কী করণীয় সেটা নিয়ে একটু বলার চেষ্টা করব।

করোনাসৃষ্ট বর্তমান দুর্যোগময় সময়ে শিক্ষার্থীরা তাদের স্বভাবজাত শারীরিক পরিশ্রম করতে পারছে না। শিশু-কিশোররা, যাদের বয়স ছয় থেকে ১৮ বছর—খেলবে, ছোটাছুটি করবে, এটাই স্বাভাবিক।  যেহেতু এই সময়ে তারা ঘর থেকে বের হতে পারছে না, তাদের মধ্যে এক ধরনের স্থবিরতা দেখা যাচ্ছে। বেশির ভাগ শহুরে বাচ্চার মধ্যে মুটিয়ে যাওয়ার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। এখন আমরা ডিজিটাল ডিভাইসভিত্তিক পড়াশোনায় চলে গিয়েছি। এর ফলে তাদের দীর্ঘ সময় কম্পিউটার, ল্যাপটপ বা মোবাইল ফোনের দিকে তাকিয়ে থাকতে হচ্ছে। এই দীর্ঘ সময়ে তাকিয়ে থাকার ফলে তাদের চোখে সমস্যা তৈরি হচ্ছে। যাদের চোখের সমস্যা আগেই ছিল, তাদের চশমার পাওয়ার দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। অনেক শিক্ষার্থীর নতুনভাবে চশমা নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। চোখে বাড়তি চাপ পড়ায় তাদের মাথা ব্যথা হচ্ছে। শুয়ে-বসে থাকায় তাদের ক্ষুধামান্দ্য হচ্ছে। রাতের বেলায় বেশি রাত পর্যন্ত জেগে থাকা এবং সকালবেলা ঘুমানোর চেষ্টার কারণে তাদের শারীরবৃত্তীয়চক্র বিঘ্নিত হচ্ছে। এ ছাড়া যেসব শারীরিক সমস্যা দেখা দিচ্ছে তা হচ্ছে : পেশির শক্তির হ্রাস, প্রাণচাঞ্চল্য হ্রাস, অস্থিসন্ধিতে ব্যথা ও হাত-পা ফুলে যাওয়া ইত্যাদি।

করোনাকালীন মানসিক সমস্যার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে একাকিত্ববোধ। অভিভাবকদের অনেকেই অভিযোগ করেন, ছাত্ররা আগের উদ্যম হারিয়ে ফেলছে। ঘরের এক কোণে ঝিম মেরে বসে থাকা, কিছু জিজ্ঞেস করলে হঠাৎ করে রাগ করা ইত্যাদি আচরণ করছে। এর কারণ ঘরের বদ্ধ পরিবেশে দীর্ঘদিন অবস্থান। তাদের এ ধরনের ব্যবহারের আরেকটা বড় কারণ হচ্ছে বয়ঃসন্ধিজনিত সমস্যা। বয়ঃসন্ধিকালীন সমস্যা সাধারণত শিক্ষার্থীদের ১০ থেকে ১৯ বছরের মধ্যেই দেখা যায়। এই বয়ঃসন্ধিকালে আমাদের সন্তানদের আত্মপরিচয় গড়ে উঠতে শুরু করে। অর্থাৎ তার নিজস্ব সিদ্ধান্ত গ্রহণের জায়গা তৈরি হয়। তার পছন্দ-অপছন্দ, সে কী চায়, সেগুলো আস্তে আস্তে গড়তে শুরু করে। তার নিজের জীবন, সমাজ, সংস্কৃতি ও ধর্ম সম্পর্কে একটা নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে ওঠে। এই দৃষ্টিভঙ্গিটা বই পড়ে, পরিবারের সবার আচার-আচরণ, ব্যবহার, স্কুল-কলেজের শিক্ষকদের উপদেশ ও বন্ধুদের সঙ্গে কথোপকথন ইত্যাদি থেকেই গড়ে ওঠে। বয়ঃসন্ধিকালে সে স্বাধীনভাবে ভাবতে শুরু করে। সে কী পারবে, সে কী খাবে, কাদের সঙ্গে মিশবে; সেটার জন্য সে সিদ্ধান্ত নিতে শুরু করে। এ সময়ে সে পরিবারের সদস্যদের বাইরেও বন্ধুদের সঙ্গে সময় দিতে পছন্দ করে। এ বয়সে সন্তানরা অভিভাবকের চেয়ে তাদের বন্ধুবান্ধবের দ্বারা বেশি প্রভাবিত হয়। এ জন্য অনেক মা-বাবা অভিযোগ করেন, তাঁদের সন্তানরা তাঁদের অধীনতা থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। আসলে এটাই স্বাভাবিক। আমরা জানি যে বয়ঃসন্ধিকালে হরমোনজনিত কারণে তার শারীরবৃত্তীয় নানা পরিবর্তন হয়। সে কারণে তার মনমেজাজ খুব দ্রুত ওঠানামা করে। সে কখনো তিরিক্ষি মনমেজাজ ধারণ করে, হঠাৎ রেগে যায়, নিজ রুমের দরজা বন্ধ করে থাকে, অন্যের কথা নেতিবাচকভাবে নেয়। আবার হঠাৎ মুষড়ে পড়ে, কোনো কথাই বলে না কারো সঙ্গে। এ সময়ে এমন রাগ, দুঃখের অনুভূতিগুলো খুব তীব্র মাত্রায় দেখা যায়।

এ থেকে উত্তরণের জন্য সন্তানকে ঘরে একটা ইতিবাচক পরিবেশ দিতে হবে। এ জন্য প্রথম যে কাজটা করতে হবে, তা হচ্ছে ধৈর্য ধরা ও সহনশীল হওয়া। অভিভাবক ও বাড়ির অন্য সদস্যদের শিক্ষার্থীদের বয়ঃসন্ধিকালীন পরিবর্তন এবং করোনাকালীন মানসিক অস্থিরতা নিরসনে তাদের সঙ্গে সময়োপযোগী আচরণ করতে হবে। আপনার সন্তানকে সময় দিন। সন্তানকে বোঝার সহজ উপায় হচ্ছে, তার সঙ্গে গল্প করা। তার সঙ্গে লুডু খেলতে পারেন, দাবা খেলতে পারেন। এমনভাবে খেলার ছলে তার সঙ্গে কথোপকথন, তার সান্নিধ্যে তাকে বুঝতে চেষ্টা করুন। তার সঙ্গে গল্পের ছলে জেনে নিন সে কার সঙ্গে মিশছে, কী আলোচনা করছে, কিভাবে সে বিকশিত হচ্ছে।

করোনাকালীন একাকিত্ব কাটাতে সন্তানকে তার শখের কাজটা করতে দিন। সে ছবি আঁকতে পছন্দ করলে তার জন্য ছবি আঁকার ব্যবস্থা করে দিন, যদি সে ছবি তুলতে পছন্দ করে, তাকে ছবি তোলার জন্য সহযোগিতা করুন। সে বই পড়তে পছন্দ করলে তাকে বই কিনে দিন। তার যদি কোনো গাছ বা পট প্লান্টের শখ থাকে, তাকে গাছ কিনে দিন। সে হয়তো একটা ছোট্ট বিড়াল অথবা পোষা পাখিতে খুশি হবে। সন্তানকে ডিজিটাল ডিভাইস থেকে দূরে রেখে তাকে ব্যস্ত রাখতে হবে। এই ব্যস্ততার সঙ্গে সঙ্গে তার বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করবেন। তাহলেই তার মন ও শরীরে যে পরিবর্তনগুলো হচ্ছে, সেগুলো আপনি বুঝতে পারবেন।

আমাদের মনে রাখতে হবে, কিশোর বয়সের শিক্ষার্থীদের নিজস্ব আবেগ তৈরি হচ্ছে। তাই তার প্রতিটি আচরণকে সম্মান জানাতে হবে। সে যেন বুঝতে পারে, তাকে সবাই যথাযথ মূল্যায়ন করছে। এ সময়ে সন্তানের সঙ্গে তর্কের মধ্যে না গিয়ে তার কথা শুনতে হবে। তাকে বুঝতে চেষ্টা করতে হবে। কোনোভাবেই তার ওপর  কোনো রকম বল প্রয়োগ বা গায়ে হাত তোলা যাবে না। অন্য কারো সঙ্গে তুলনা করা যাবে না বা অন্য কাউকে দিয়ে তাকে ছোট করা যাবে না। এটা আমরা সব সময় ভুল করি, অমুকের ছেলে ভালো করছে, তমুকের ছেলের স্বাস্থ্য ভালো ইত্যাদি। এটা তাদের মনে এক ধরনের ডিপ্রেশন তৈরি করে, যেটা তাদের উপকারের চেয়ে অপকারই করে থাকে। সে যদি কোনো ভুল করে বা করতে যায়, তাহলে সেটা তাকে বুঝিয়ে বলতে হবে। খেয়াল করতে হবে, যেন তার আত্মসম্মানে আঘাত না লাগে। তাকে ভালো-মন্দের ব্যবধানটাও যুক্তি দিয়ে আমাদের বুঝিয়ে বলতে হবে। তাদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তার ব্যাপারে আমাদের শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। তার সঙ্গে আস্থাশীল আচরণ করতে হবে। তাকে বিশ্বাস করতে হবে এবং সে যেন আপনার বিশ্বাসের মর্যাদা রাখে সেটা বোঝাতে হবে।

তার প্রিয় বন্ধুদের প্রতি সরাসরি কোনো মন্তব্য না করে তাদের  মধ্যে কেউ যদি নেতিবাচক কোনো কাজে জড়িত থাকে, তাহলে তাকে সেটা বুঝিয়ে বলুন। তার বন্ধুদের মধ্যে যে বিষয়গুলো ভালো, সেগুলো নিয়ে আলোচনা করুন। তাকে তার ভালো-মন্দের সীমাটা নির্ধারণ করে দিন। সে কী করতে পারবে, কী করতে পারবে না—এটা নির্ধারণ করে দিন। তাকে বলুন সে কত দূর সাইকেল চালাতে পারবে, বয়স অনুযায়ী কী কী মুভি দেখতে পারবে, দিনে কতক্ষণ ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহার করতে পারবে ইত্যাদি।

তার ভালো কাজের প্রশংসা করুন। সে যে আপনার কথা শুনছে, আপনার আদেশ পালন করছে, সে যে ভালো কিছু করছে, তার প্রশংসা করুন। তাকে বুঝতে দিন আপনি তাকে খেয়াল করছেন। আপনার অনাগ্রহ ও ব্যস্ততায় সে মনে করতে পারে তার ভালো-মন্দে আপনার কিছু যায়-আসে না। এই সময় বাচ্চারা খুব স্পর্শকাতর থাকে। তারা মা-বাবা, আত্মীয়-স্বজন বা পাড়া-প্রতিবেশীর দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করে। সেটা দেখুন ও তাকে অবশ্যই উৎসাহিত করুন এবং খারাপ কিছু দেখলে তাকে বুঝিয়ে বলুন। তাকে বলুন, সে যেটা করছে তা তার পারিবারিক ঐতিহ্য ও পারিবারিক মর্যাদার সঙ্গে কতটা যায়।

বাড়ন্ত বয়সের শিক্ষার্থীদের প্রথম যেটা প্রয়োজন, সেটা হচ্ছে সুষম খাবার। আপনাকে অবশ্যই এদের প্রাত্যহিক খাবার তালিকায় ডিম, দুধ, শাক-সবজি রাখতে হবে। চেষ্টা করতে হবে দিনের একবেলা পরিবারের সবাই একসঙ্গে খেতে, বিশেষ করে রাতের খাবারটা। টেবিলে অন্য যেসব খাবার আছে, তা দেখে সে নতুন খাবার খেতে শিখবে। এ বয়সে অনেক শিশুই সবজি খেতে চায় না। তাকে বোঝাতে হবে যে তোমার বাড়ন্ত শরীরের জন্য, সুস্থ চোখের জন্য সবজি খেতে হবে। করোনার জন্য এই সময়ে শিক্ষার্থীদের আমরা বাইরে বেড়াতে নিতে পারছি না, তারা খোলা মাঠে দৌড়ে খেলাধুলা করতে পারছে না। সে ক্ষেত্রে তাকে আমরা নিয়মিত ঘরে বসেই খালি হাতে ব্যায়াম করতে উৎসাহিত করব। এই বয়সের বাচ্চাদের যান্ত্রিক বা ওজন দিয়ে ব্যায়াম করার দরকার নেই, কোনো দামি জিমের দরকার নেই। অভিভাবকরা ইউটিউব বা বিভিন্ন মাধ্যম থেকে ফ্রি হ্যান্ড এক্সারসাইজের তালিম নিতে পারেন। হাঁটার জন্য বিকেলে বা সন্ধ্যাবেলা বাসার ছাদে যেতে পারেন অথবা রাতের খাবারের পরে ছাদে যেতে পারেন। ছাদে গিয়ে সন্তানকে দিগন্ত দেখার চেষ্টা করতে বলুন। যদি আমরা পার্কে যেতে পারি, তাকে সবুজ দেখার চেষ্টা করতে বলুন।

আপনার সন্তানকে নিয়মিত স্বাস্থ্যবিধি তথা ২০ সেকেন্ডের জন্য সাবান দিয়ে হাত ভালোভাবে ধোয়া, সব সময় মাস্ক পরিধান করা এবং নিরাপদ দূরত্ব অর্থাৎ ছয় ফুট দূরত্ব বজায় রাখা, কোনো জনপূর্ণ এলাকায় না যাওয়া মেনে চলতে বলুন। কোনো জায়গায় যদি তাদের যেতেই হয়, সে ক্ষেত্রে বাসায় আসার পরে   ভালোভাবে হাত ধুতে বলুন।

করোনার এই দুঃসময়ে আমাদের সন্তানদের যেন কোনো ক্ষতি না হয় সেদিকে লক্ষ রাখুন। এই দুঃসময়েও দেহমনে স্বাস্থ্যবান ও সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে সাহায্য করতে হবে।

লেখক: অধ্যক্ষ, ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজ

– দৈনিক পঞ্চগড় নিউজ ডেস্ক –