• বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ১১ ১৪৩১

  • || ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫

সর্বশেষ:
যুদ্ধের অর্থ জলবায়ু পরিবর্তনে ব্যয় হলে বিশ্ব রক্ষা পেত- প্রধানমন্ত্রী দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদনের রেকর্ড মেডিকেল কলেজের ক্লাস অনলাইনে নেয়ার নির্দেশ স্বাস্থ্যমন্ত্রীর ‘গণতান্ত্রিক রীতিনীতি না মানলে জনগণই বিএনপিকে প্রতিহত করবে’ লালমনিরহাটে হত্যা মামলায় বিএনপির দুই নেতা কারাগারে

২৬ মার্চ : একটি জাতিরাষ্ট্রের জন্ম

প্রকাশিত: ২৭ মার্চ ২০২২  

আব্দুর রহমান

২৬ মার্চ মহান স্বাধীনতা দিবস। সুদীর্ঘ দিনের বহু প্রজন্মের পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে নিজেদের স্বাধীন জাতি হিসেবে ঘোষণা করার দিন। ঔপনিবেশিক শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বাঙালির লড়াইয়ের ইতিহাস অনেক দীর্ঘ। স্বাধীনতার সুতীব্র আকাঙ্ক্ষা থেকে প্রজন্মের পর প্রজন্ম এ জাতি রক্ত দিয়েছে, নিজেদের জীবনকে অকাতরে উত্সর্গ করেছে।

সংগ্রামের পথে গৌরবময় মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছে। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে আত্মাহুতি দিয়েছেন মাস্টারদা সূর্য সেন, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের মতো অগণিত সূর্যসন্তান। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসনের অবসান এবং দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে দেশভাগের মাধ্যমে পাকিস্তানের জন্মের পরপরই আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতির ওপর আঘাত এলো প্রথমেই। শুরু হলো নতুন লড়াই। সে লড়াই ছিল প্রথমত জাতি হিসেবে নিজেদের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখার। নিজেদের ভাষা, সংস্কৃতি ও অর্থনৈতিক মুক্তির লড়াই।

পাকিস্তানের বেশির ভাগ মানুষের মাতৃভাষা বাংলা হলেও উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার ষড়যন্ত্র শুরু হয়। ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত পাকিস্তান গণপরিষদের অধিবেশনের সব কার্যবিবরণী ইংরেজি ও উর্দুর পাশাপাশি বাংলায়ও রাখার দাবি উত্থাপন করেন। কিন্তু সে প্রস্তাব পাস হলো না। ঢাকাসহ সারা দেশে ক্রমান্বয়ে প্রতিবাদ দানা বাঁধতে থাকে। ১৯৪৮ সালের ২ মার্চ ফজলুল হক হলের এক সভায় শামসুল আলমকে আহ্বায়ক করে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়।  

২১ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে এক নাগরিক সংবর্ধনায় পাকিস্তানের গভর্নর মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঘোষণা করলেন, ‘উর্দু অ্যান্ড অনলি উর্দু শ্যাল বি দ্য স্টেট ল্যাঙ্গুয়েজ অব পাকিস্তান। ’ ২৪ মার্চ কার্জন হলে সমাবর্তন অনুষ্ঠানে তিনি একই কথার পুনরাবৃত্তি করলে উপস্থিত ছাত্ররা তাত্ক্ষণিকভাবে এর প্রতিবাদ জানায়।  

এর আগে ১১ মার্চ ১৯৪৮ ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ দাবিতে সর্বাত্মক সাধারণ ধর্মঘট পালন করতে গিয়ে গ্রেপ্তার হন সে সময়কার উজ্জ্বল ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমান, কাজী গোলাম মাহবুব, শামসুল হক, আব্দুল ওয়াহেদ চৌধুরী, অলি আহাদ প্রমুখ। ১১ মার্চের প্রেক্ষাপট থেকেই ভাষা আন্দোলন, স্বাধিকার আন্দোলন এবং পরবর্তীকালে স্বাধীনতা আন্দোলন বিকশিত হতে থাকে।

১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলার সোনার ছেলেদের রক্তে ভিজে গেল রাজপথ। পুলিশের গুলিতে নিহত হন সালাউদ্দিন, সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার, শফিউরসহ অনেকে। ১৯৫২ সালের রক্তাক্ত রাজপথ ধরে একেকটি ধারাবাহিক রাজনৈতিক আন্দোলনের মাধ্যমে স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধিকারের দাবিতে বাংলার মানুষ ক্রমান্বয়ে উজ্জীবিত হতে থাকে। ভাষা আন্দোলন-পরবর্তী ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন বাংলার রাজনৈতিক শক্তিকে জানান দিতে সক্ষম হয়। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে শরীফ শিক্ষা কমিশন বাতিলের পাশাপাশি কারাবন্দি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মুক্তি নিশ্চিত করার মধ্য দিয়ে নিজেদের রাজনৈতিক চেতনার স্ফুরণ ঘটতে থাকে।  

১৯৬৬ সালে তত্কালীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমানের ছয় দফা উত্থাপনের মধ্য দিয়ে স্বাধিকারের দাবিটি সামনে চলে আসে। বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা ছিল স্বাধীনতার পথে প্রথম সুস্পষ্ট ও সুপরিকল্পিত কর্মসূচি। তাঁর ছয় দফা ছিল বাঙালির মুক্তির সনদ। বঙ্গবন্ধুর দূরদর্শী ও বলিষ্ঠ নেতৃত্বই ক্রমান্বয়ে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে এবং স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখাতে শুরু করে।  

১৯৬৯ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে ফাঁসিতে ঝোলানোর চক্রান্ত হয়। এর প্রতিবাদে তীব্র গণ-আন্দোলনের মুখে পাকিস্তান সরকার বাংলার অবিসংবাদিত নেতা আওয়ামী লীগের প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয় এবং ১৯৬৯ সালের মার্চ মাসে আইয়ুব খান ক্ষমতা ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। সেনাপ্রধান জেনারেল ইয়াহিয়া খান দায়িত্ব গ্রহণ করে সামরিক শাসন জারি করেন। এরপর ইয়াহিয়া খান পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করেন।

১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রচার ছিল ছয় দফাকেন্দ্রিক এবং নির্বাচনী প্রচারাভিযান শুরু হয় ৭ জুন ছয় দফা দিবসেই। ১৯৬৬ সাল থেকে আওয়ামী লীগ ছয় দফা কর্মসূচিকে তাদের প্রধান রাজনৈতিক কর্মসূচি হিসেবে তুলে ধরে। ১৯৭০ সালের নির্বাচন সামনে রেখে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমরা যদি সময়ের ডাকে সাড়া দিতে ব্যর্থ হই, তাহলে আগামী প্রজন্ম আমাদেরকে দায়ী করবে। ’

১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত ওই নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের ১৬২টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ ১৬০টি আসনে জয়লাভ করে। নির্বাচনে এককভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করা সত্ত্বেও আওয়ামী লীগ নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সরকার গঠনে আহ্বান করার পরিবর্তে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ১৯৭১ সালের ১ মার্চ জাতীয় পরিষদ অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করেন। এর প্রতিবাদে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে পূর্ব পাকিস্তানে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়। ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে বঙ্গবন্ধু জাতিকে মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হওয়ার ডাক দেন এবং ঘোষণা করেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। ’

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ঘুমন্ত নিরস্ত্র বাঙালির ওপর আধুনিক যুদ্ধাস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল৷ বাংলার মানুষের স্বাধিকার আন্দোলন, এমনকি জাতীয় নির্বাচনের ফলের আইনসংগত অধিকারকেও রক্তের বন্যায় ডুবিয়ে দিতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী সারা দেশে গণহত্যা শুরু করেছিল৷ সেই রাতে তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল, ইকবাল হল, রোকেয়া হল, শিক্ষকদের বাসা, পিলখানার ইপিআর সদর দপ্তর, রাজারবাগ পুলিশ লাইনে একযোগে নৃশংসতা চালিয়ে হত্যা করে নিরস্ত্র দেশপ্রেমিক ও দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের৷ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় একাধিক গণকবর খুঁড়ে সেখানে শত শত লাশ মাটিচাপা দিয়ে তার ওপর বুলডোজার চালায়৷ নগরীর বিভিন্ন স্থানে সারা রাত ধরে হাজার হাজার লাশ মাটিচাপা দেওয়া হয়৷ পুরান ঢাকার বুড়িগঙ্গায় ভাসিয়ে দেওয়া হয় অসংখ্য মানুষের মৃতদেহ।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাতে জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হন। গ্রেপ্তার হওয়ার একটু আগে ২৫ মার্চ রাত ১২টার পর (২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে) তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করেন, যা চট্টগ্রামে অবস্থিত তত্কালীন ইপিআরের ট্রান্সমিটারে করে প্রচার করার জন্য পাঠানো হয়। ঘোষণাটি নিম্নরূপ : ‘এটাই হয়ত আমার শেষ বার্তা, আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। আমি বাংলাদেশের মানুষকে আহ্বান জানাই, আপনারা যেখানেই থাকুন, আপনাদের সর্বস্ব দিয়ে দখলদার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে শেষ পর্যন্ত প্রতিরোধ চালিয়ে যান। বাংলাদেশের মাটি থেকে সর্বশেষ পাকিস্তানি সৈন্যটিকে উত্খাত করা এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জনের আগ পর্যন্ত আপনাদের যুদ্ধ অব্যাহত থাকুক। ’

বঙ্গবন্ধু ঘোষিত বাংলাদেশের স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা হ্যান্ডবিল আকারে ইংরেজি ও বাংলায় ছাপিয়ে চট্টগ্রামে বিলি করা হয়৷ আওয়ামী লীগের শ্রম সম্পাদক জহুর আহমেদ চৌধুরী বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা চট্টগ্রামের ইপিআর সদর দপ্তর থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে ওয়্যারলেস মারফত পাঠানোর ব্যবস্থা করেন৷ চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এম এ হান্নান দুপুর ২টা ১০ মিনিটে এবং ২টা ৩০ মিনিটে চট্টগ্রাম বেতার থেকে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেন।

১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার মধ্য দিয়ে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। স্বাধীনতাকামী নিরস্ত্র বাঙালি দেশমাতৃকার মুক্তির জন্য নিজেদের জীবন বাজি রেখে সশস্ত্র পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ২৫ মার্চ মধ্যরাত থেকে শুরু হওয়া হত্যাযজ্ঞের ধ্বংসস্তূপের মধ্য থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষ ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে মুক্তিযুদ্ধ ও দেশ স্বাধীন করার শপথ গ্রহণ করে৷ ওই রাতেই তত্কালীন পূর্ব বাংলার পুলিশ, ইপিআর ও সেনাবাহিনীর সদস্যরা শুরু করেন প্রতিরোধ যুদ্ধ, সঙ্গে যোগ দেয় সাধারণ মানুষ৷ দীর্ঘ ৯ মাসের সশস্ত্র যুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদের রক্ত ও দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রম হারানোর ক্ষত নিয়ে ১৬ই ডিসেম্বর অর্জিত হয় জাতির কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা৷ জন্ম হয় স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের।

লেখক : সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ

– দৈনিক পঞ্চগড় নিউজ ডেস্ক –