• বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ১০ ১৪৩১

  • || ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫

সর্বশেষ:
যুদ্ধের অর্থ জলবায়ু পরিবর্তনে ব্যয় হলে বিশ্ব রক্ষা পেত- প্রধানমন্ত্রী দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদনের রেকর্ড মেডিকেল কলেজের ক্লাস অনলাইনে নেয়ার নির্দেশ স্বাস্থ্যমন্ত্রীর ‘গণতান্ত্রিক রীতিনীতি না মানলে জনগণই বিএনপিকে প্রতিহত করবে’ লালমনিরহাটে হত্যা মামলায় বিএনপির দুই নেতা কারাগারে

ইসলামে পরিমিত খাদ্যগ্রহণের গুরুত্ব ও উপকারিতা

প্রকাশিত: ৮ মার্চ ২০২৩  

 
মহান রাব্বুল আলামিন আল্লাহ তাআলা মানবজাতিকে পৃথিবীতে প্রেরণের সঙ্গে সঙ্গে বেঁচে থাকার জন্য নানা রকমের খাদ্যের ব্যবস্থা করেছেন। তবে শারীরিক সুস্থতার জন্য পরিমিত আহার যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা আমাদের সবারই জানা। 
বিশ্ব নবী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহ ওয়া সাল্লাম বলেন, দুটি নেয়ামত রয়েছে, যে দুটিতে বহু মানুষ ধোঁকায় পতিত হয়েছে- স্বাস্থ্য এবং অবসর। বুখারি হা/৬৪১২; মিশকাত হা/৫১৫৫। কখনো অবসরকে কাজে লাগানো বা সময়ের মূল্য দিলেও স্বাস্থ্য সুরক্ষাকে আমরা তেমন গুরুত্বই দেই না। অথচ এটাও আমাদের ধর্মীয় কর্তব্যেরই অংশ।

যেমন বিশ্ব নবী রাসূলুল্লাহ (সা.) স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য পরিমিত আহার গ্রহণের উপদেশ দিয়ে বলেন, ‘পেট অপেক্ষা নিকৃষ্টতর কোনো পাত্র মানুষ পূর্ণ করে না। আদম সন্তানের জন্য ততটুকু খাদ্যই যথেষ্ট যতটুকুতে তার পিঠ সোজা থাকে। আর যদি এর চেয়ে বেশি খেতেই হয়, তাহলে সে যেন তার পেটের এক-তৃতীয়াংশ আহারের জন্য, এক-তৃতীয়াংশ পানের জন্য এবং এক-তৃতীয়াংশ শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য ব্যবহার করে’। (তিরমিযী হা/২৩৮০; সহিহুল জামে হা/৫৬৭৪)

রাসূলুল্লাহ (সা.) অধিক রসনাবিলাসীদের নিন্দা করে বলেন, إِنَّ مِنْ شِرَارِ أُمَّتِيَ الَّذِيْنَ غُذُّوْا بِالنَّعِيْمِ، هِمَّتُهُمْ أَلْوَانَ الطَّعَامِ وَأَلْوَانَ الثِّيَابِ يَتَشَدَّقُوْنَ فِي الْكَلَامِ‘আমার উম্মতের সবচেয়ে নিকৃষ্ট লোকদের মধ্যে রয়েছে ঐ সব ব্যক্তি, যারা অবাধ বিলাসব্যসনের মধ্যে জীবনযাপন করে, যাদের আকাংখা কেবল নানাবিধ খাদ্য ভক্ষণ করা আর নানার রংয়ের পোষাক পরিধান করা। তারা মানুষের প্রতি উপহাসচ্ছলে বল্গাহীন কথাবার্তা বলে (সিলসিলা সহিহাহ হা/১৮৯১)।

একদিন জনৈক কাফের রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর অতিথি হলো। রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নির্দেশক্রমে এবং তার চাহিদামতো তার জন্য একে একে ৭টি বকরির দুধ দোহন করে পরিবেশন করা হলে উক্ত ব্যক্তি সবটুকুই খেয়ে নিলো। পরদিন সকালে সে ইসলাম গ্রহণ করল। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সা.) একইভাবে তাকে দুধ দিতে বললেন। কিন্তু লোকটি একটির বেশি বকরির দুধ পান করতে সক্ষম হলো না। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, ‘মুসলিম খায় একটি মাত্র পেটে, পক্ষান্তরে কাফের খায় সাত পেটে। (মুসলিম হা/২০৬৩; তিরমিযী হা/১৮১৯)

আবূ জুহাইফা (রা.) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, একদিন আমি গোশত ও রুটি মিশ্রিত সারিদ (গোশতের ঝোলে ভেজানো টুকরো টুকরো রুটি দিয়ে তৈরি বিশেষ খাদ্য) খেলাম এবং রাসূল (সা.) এর সামনে ঢেকুর তুলতে তুলতে আসলাম। তিনি বললেন, كُفَّ عَنَّا جُشَاءَكَ فَإِنَّ أَكْثَرَهُمْ شِبَعًا فِي الدُّنْيَا أَطْوَلُهُمْ جُوعًا يَوْمَ القِيَامَةِ ‘আমাদের সামনে তোমার ঢেকুর তোলা বন্ধ কর। নিশ্চয় যেসব ব্যক্তি দুনিয়াতে বেশি পরিতৃপ্ত হবে, তারাই কিয়ামতের দিন সবচেয়ে বেশি ক্ষুধার্ত থাকবে’। (হাকেম; সহিহুত তারগীব হা/২১৩৬)

রাসূলুল্লাহ (সা.) ও সাহাবায়ে কেরাম সর্বদা পরিমিত আহারকে প্রাধান্য দিতেন। যেমন আবূ হুরায়রা (রা.) বলেন, ওই সত্তার কসম! যার হাতে আবূ হুরায়রার প্রাণ। দুনিয়া থেকে বিদায় গ্রহণ করা পর্যন্ত একাধারে তিন দিন পর্যন্ত নবী করিম (সা.) ও তার পরিবার গমের রুটি দ্বারা পরিতৃপ্ত হননি (মুসলিম হা/২৯৭৬)

ওমর (রা.) বলেছেন, ‘মানুষ আজ কী পরিমাণ দুনিয়া কামাই করেছে! অথচ রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে আমি দেখেছি যে, তিনি ক্ষুধার তাড়নায় সারাদিন অস্থির থাকতেন। পেট ভরার মতো নিম্নমানের একটি খেজুরও তিনি (খেতে) পাননি’ (মুসলিম হা/২৯৭৮)

আনাস (রা.) বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর পরিবারের নিকট কোনো সন্ধ্যাতেই এক সা গম বা কোনো খাদ্যদানা (আগামীকালের জন্য) অবশিষ্ট থাকত না। অথচ তার স্ত্রী ছিলেন নয় জন’ (অর্থাৎ তিনি যা পেতেন সবই দান করে দিতেন। জমা রাখতেন না) (বুখারি হা/২০৬৯)

একদিন আবু হুরায়রা (রা.) একদল মানুষের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। যাদের সামনে একটা ভুনা বকরি ছিল। তারা তাকে খাওয়ার জন্য দাওয়াত দিলেন। কিন্তু তিনি অস্বীকার করে বললেন, ‘রাসূলুল্লাহ (সা.) দুনিয়া থেকে বিদায় হয়ে গেছেন। অথচ কখনো একটি যবের রুটি দিয়েও পরিতৃপ্ত হননি।’ (বুখারি হা/৫৪১৪)

একদিন ক্ষুধার জ্বালায় রাসূলুল্লাহ (সা.) ঘর থেকে বেরিয়ে আসলেন। পথে আবুবকর ও ওমর (রা.)-কে দেখতে পেয়ে জানতে পারলেন, তারাও ক্ষুধার কারণে খাবারের খোঁজে বাইরে এসেছেন। তারপর তারা একজন আনসারি সাহাবির গৃহে দাওয়াত গ্রহণ করলে তিনি তাদের খেজুর, গোশত ও পানি দ্বারা আপ্যায়ন করলেন। তৃপ্তি সহকারে খাদ্যগ্রহণের পর রাসূলুল্লাহ (সা.) তাৎপর্যপূর্ণ যে কথাটি বললেন তা হলো, যে সত্তার হাতে আমার জীবন, তার কসম! কিয়ামতের দিন এ নেয়ামত সম্পর্কেও তোমরা জিজ্ঞাসিত হবে। ক্ষুধা তোমাদের বাড়ি হতে বের করে এনেছিল, অথচ তোমরা এ নেয়ামত লাভ করে বাড়িতে ফিরে যাচ্ছো (মুসলিম হা/২০৩৮)

রাসূলুল্লাহ (সা.) যখন লোকদের সঙ্গে নিয়ে জামাআতে সালাত আদায় করতেন, তখন আহলে সুফফার কিছু লোক ক্ষুধার যন্ত্রণায় সালাতে দাঁড়ানো অবস্থা থেকে পড়ে যেতেন। তাদের এ অবস্থা দেখে বেদুঈনরা বলতো, এরাতো পাগল। রাসূলুল্লাহ (সা.) সালাত শেষে তাদের দিকে মুখ ফিরিয়ে বলতেন, ‘আল্লাহ তাআলার নিকট তোমাদের যে কতো নেয়ামতের ভান্ডার রয়েছে তা যদি তোমরা জানতে, তাহলে তোমরা বেশি বেশি ক্ষুধার্ত ও অভাব-অনটনে থাকতে পসন্দ করতে।’ (তিরমিযী হা/২৩৬৮; সহিহাহ হা/২১৬৯)

অপরিমিত খাদ্যগ্রহণ তাক্বওয়াপূর্ণ জীবনযাপনের ক্ষেত্রেও অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। তাইতো যারা ইবাদতে খুশূ-খুযূ হারিয়ে ফেলেছেন এবং আল্লাহভীতির অশ্রু খুঁজে ফিরছেন তাদের প্রতি হাসান বসরি (রহ.)-এর উপদেশ, ‘যিনি হৃদয়জগতে আল্লাহভীরুতা কামনা করেন এবং চোখ থেকে অঝোর ধারায় অশ্রু প্রবাহিত করতে চান, তিনি যেন অর্ধেক পেট খাবার গ্রহণ করেন’ (আদাবুল হাসান বাসরি)

ইমাম শাফেঈ (রহ.) বলেন, ‘১৬ বছর বয়স থেকে আমি আর কখনো (খাদ্যগ্রহণের ক্ষেত্রে) পূর্ণ পরিতৃপ্ত হইনি। বরং তা প্রত্যাখ্যান করেছি। কেননা পরিতৃপ্তি শরীরকে ভারী করে, হৃদয়কে কঠিন করে, বিচক্ষণতা দূরীভূত করে, ঘুম আনায়ন করে এবং ইবাদত থেকে দূর্বল করে দেয়।’ (ইবনু আবী হাতেম, আদাবুশ শাফেঈ পৃ.৭৮)

সুতরাং আসুন! আজকের এই বস্ত্তবাদী দুনিয়ায় আমরা অধিক বিলাস-ব্যাসন থেকে নিজেকে বিরত রাখি। যখন-তখন বন্ধু-বান্ধবদের নিয়ে বিলাসবহুল হোটেলে-রেস্তোরাঁয় অপ্রয়োজনীয় সময় কাটানো, সময় ও খাদ্যের অপচয় থেকে বিরত থাকি। আল্লাহ আমাদের তাওফিক দান করুন। আমিন।

– দৈনিক পঞ্চগড় নিউজ ডেস্ক –