• শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ১৪ ১৪৩০

  • || ১৮ রমজান ১৪৪৫

আলেমদের ভ্রষ্টতায়ও আল্লাহর গজব নেমে আসতে পারে

প্রকাশিত: ২০ এপ্রিল ২০২০  

ধর্মীয় দৃষ্টিকোন থেকে নবীদের পরেই আলেমদের মর্যাদা। হাদিসের ভাষায় ‘আলেমরা নবীর ওয়ারিশ।’ আলেমের মর্যাদা সম্পর্কে সরাসরি আল কোরআনে আয়াত নাজিল হয়েছে। বলা হয়েছে, ‘যাদেরকে এলেম দেয়া হয়েছে, আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে অনেক স্তরে মর্যাদা দিয়েছেন।’ (সূরা : মুজাদালা, আয়াত : ১১)।

আলেমদের মর্যাদার কারণ হলো তারা নবীদের আদর্শকে বাস্তবায়ন করেন। শয়তানের প্ররোচনা ও ধোঁকায় পড়ে যারা পথভ্রষ্ট হয়, আলেমরা তাদেরকে সরল পথের দিশা দেন। বড় ব্যক্তিদের ভালো উদ্যোগের ফল হয় অনেক ব্যাপক। তাদের পদস্খলনেও নেমে আসতে পারে পুরো জাতির ওপর বিপর্যয়। তাই আলেমদের ব্যাপারে রাসূল (সা.) এর জবান থেকে হাদিসের বহু জায়গায় হুঁশিয়ারি এসেছে। এক হাদিসে এসেছে, ‘আল্লাহ তায়ালা দুনিয়া থেকে এলেম ওঠিয়ে নেবেন। তবে তা মানুষের ভেতর থেকে হঠাৎ নাই করে দেয়ার মাধ্যমে নয়। যোগ্য আলেমদেরকে নিজের কাছে নিয়ে যাওয়ার মাধ্যমে এলেম ওঠিয়ে নেবেন। এক পর্যায়ে দুনিয়াতে কোনো যোগ্য আলেম থাকবে না। তখন জাহেল লোকেরা আলেমের পোশাক পরিধান করবে। মানুষ এসে তাদের কাছে দ্বীনি বিষয় জিজ্ঞেস করবে। তারা তখন কোরআন, হাদিসের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে নিজেরা পথভ্রষ্ট হবে, অন্যদেরকেও পথভ্রষ্ট করবে।’ (সহিহ বুখারী ও সহীহ মুসলিম)।

উক্ত হাদিসে যে বিপর্যয় নেমে আসার কথা বলা হয়েছে, তা হলো ধর্মীয় বিপর্যয়। লেবাসধারী আলেমের কারণে মানুষের দ্বীন ঈমান নষ্ট হবে। জাগতিক দিক থেকেও মানুষের বিপদ হতে পারে আলেমের নীতিহীনতার কারণে। আল কোরআনে এর বিবরণ এসেছে।

আল কোরআনে বহু ঘটনার বিবরণ আল্লাহ তায়ালা দিয়েছেন। একটা প্রশ্ন আসা স্বাভাবিক যে, কোরআনে এত ঘটনার বিবরণ কেন এসেছে? কোরআন নাজিলের অন্যতম একটা উদ্দেশ্য হলো, পূর্ববর্তী ঘটনাগুলো মুসলমানকে জানিয়ে তা থেকে উপদেশ গ্রহণের সুযোগ করে দেয়া। সে উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে আল কোরআনে সূরা আ’রাফের ১৭৬ ও ১৭৭ নম্বর আয়াতে একটি ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে। যেখানে একজন আলেমের ভ্রষ্টতার কারণে পুরো একটা জাতির ওপর বিপর্যয় নেমে এসেছিলো। নিম্নে এর বিস্তারিত তুলে ধরা হলো।

আল কোরআনে ইহুদি এক আলেমের বিবরণ ও বর্তমান সময়ের আলেমদেরর তা থেকে শিক্ষা :

ঘটনাটি আল কোরআনে বিবৃত হয়েছে এভাবে, ‘আপনি তাদের বিবরণ দেন ওই লোকের, যাকে আমি নিজের নিদর্শন সমূহ (বহু আসমানি কিতাবের ইলম) দান করেছিলাম, কিন্তু সে তার অবমূল্যায়ন করে অন্য পথ অবলম্বণ করে। এরপর তার পেছনে লাগে শয়তান। ফলে সে পথভ্রষ্টদের অন্তর্ভূক্ত হয়ে যায়। আমার ইচ্ছা হলে তার মর্যাদা বৃদ্ধি করে দিতাম নিদর্শন সমূহের বদৌলতে। কিন্তু সে দুনিয়ার মোহে পড়ে মনের খায়েশের অনুগামী হয়ে রয়েছে। পরিণতিতে তার অবস্থা হলো কুকুরের মতো। যদি তাকে তাড়া করা হয় তবুও হাঁপায় আর ছেড়ে দিলেও হাঁপায়। এ হলো সেসব লোকের উদাহরণ, যারা মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছে আমার আয়াত সমূহকে। এতএব, আপনি বলুন এসব কাহিনী, যেন মানুষ চিন্তা করে।’

ওই আলেমের পরিচয় :

উল্লিখিত আয়াতে ইহুদি এক আলেমের বিবরণ শুনানোর জন্য রাসূল (সা.)-কে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। যেন এই উম্মতের আলেমরা তা থেকে শিক্ষাগ্রহণ করতে পারে। ওই আলেম আল্লাহর মারেফতের সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছার পরও নিজের স্বার্থ, কামনা-বাসনা হাসিলের পেছনে পড়ে। পরিণতিতে সে গোমরাহি ও পথভ্রষ্টতায় নিমজ্জিত হয়। পার্থিব সম্মানের যে মুকুট জাতি তার মাথায় দিয়েছিলো তাও তাকে হারাতে হয়। আল কোরআনে ওই আলেমের নাম উল্লেখ করা হয়নি। মুফাসসিরদের থেকে এ ব্যাপারে বিভিন্ন মত পাওয়া যায়। সেগুলোর মাঝে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য মত হচ্ছে, যা ইবনে আব্বাস (রা.) এর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে যে, ওই আলেমের নাম ছিলো বালআম ইবনে বাঊরা। সে ছিলো সিরিয়ার অধিবাসী। এক বর্ণনায় পাওয়া যায় ওই আলেম বনি ইসরাইলের সদস্য ছিলো। আসমানি কয়েকটি কিতাবের ইলেম ছিলো।

ভ্রষ্টতার বিবরণ :

হজরত মুসা (আ.) মিসর ছেড়ে চলে এলেন সিরিয়ায়। সঙ্গে আসে ইহুদিদের বারটি গোত্র। আল্লাহ তায়ালার তরফ থেকে মুসা (আ.) এর ওপর নির্দেশ এলো, ইহুদিদের নিয়ে জাব্বারিনদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হবে। জাব্বারিন হলো প্রবল শক্তিশালী একটা সম্প্রদায়। যারা বাইতুল মুকাদ্দাস এলাকা দখল করে রেখেছিলো। অন্যদিকে জাব্বারিনরাও মুসা (আ.) সম্পর্কে জেনেছিলো। মিসরের প্রতাপশালী শাসক ফেরাউন তার কাছে পরাজিত হয়েছে। তাছাড়া মুসা (আ.) এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ইহুদিদের বারটি গোত্র। তাই জাব্বারিনরা ভয় পেয়ে যায়। ওই এলাকার বড় আলেম ও বুযূর্গ ব্যক্তি ছিলেন বালআম ইবনে বাঊরা। সবাই মিলে তার কাছে এসে আবেদন করে যে, আপনি দোয়া করেন যেন আল্লাহ তায়ালা মুসা ও ইহুদিদেরকে এ এলাকায় প্রবেশ থেকে ফিরিয়ে দেয়। ‘ইসমে আজম’ পড়ে দোয়া করলে দোয়া কবুল হয়। বালআম ইবনে বাঊরা ‘ইসমে আজম’ জানতো। তাই তার দোয়া কবুল হতো। প্রথম প্রথম বালআম তাদের আবেদনকে প্রত্যাখ্যান করে। কারণ, সেখানে আল্লাহর নবী হজরত মুসা (আ.) আছেন। তার সহযোগিতার জন্য রয়েছেন ফেরেশতা। আর নবী ও ফেরেশতার বিপক্ষে দোয়া করলে দুনিয়া-আখেরাত উভয়ই বরবাদ হয়ে যায়। কিন্তু সমাজের প্রভাবশালী লোকেরা তাকে পীড়াপীড়ি করতে থাকে।

এক পর্যায়ে সে বলে, আমি আগে ইস্তেখারা করে আল্লাহর কাছ থেকে জানি, এ ব্যাপারে দোয়া করা যাবে কিনা? ইস্তেখারা করার পর স্বপ্নযোগে তাকে কঠোরভাবে নিষেধ করে দেয়া হয়। সম্প্রদায়ের লোকদের বিষয়টি জানালে তারা সরাসরি কোনো কিছু বলেনি। বরং তারা কৌশল অবলম্বন করে। একটা লোভনীয় উপঢৌকন দিয়ে পাঠায়। মূলত এটা ছিলো ঘুষ। কোনো কোনো বর্ণনায় এসেছে, কাজ করিয়ে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তার স্ত্রী ওই উপঢৌকন গ্রহণ করে। সম্পদের মোহ ও স্ত্রীর সন্তুষ্টি কামনার জন্য সে মুসা (আ.) ও ইহুদিদের বিপক্ষে দোয়া করতে আরম্ভ করে। যতই দোয়া করছিলো, তা মুসা (আ.) ও ইহুদিদের পরিবর্তে নিজ সম্প্রদায়ের বিপক্ষে যাচ্ছিলো। এতে সম্প্রদায়ের লোকেরা চেঁচামেচি শুরু করে দেয়। বালআম তখন তাদের উদ্দেশ্যে বলে, এটা আল্লাহর কুদরত। আমার করার কিছু নাই। আমার দুনিয়া ও আখেরাত বরবাদ হয়ে গেছে। তাই আমি তোমাদেরকে কৌশল শিখিয়ে দিচ্ছি। তা যদি করতে পার আর তা কাজে লাগে তাহলে তোমরা সফল। নিজেদের সুন্দরী মেয়েদেরকে সাজিয়ে মুসার বাহিনীতে ছেড়ে দাও। বলে দাও, বাহিনীর কেউ কিছু করতে চাইলে কেউ যেন বাধা না দেয়। এরা মুসাফির, দীর্ঘ দিন যাবত পরিবার থেকে দূরে। তাই সহজেই তারা ব্যভিচারে লিপ্ত হবে। আল্লাহর নিকট ব্যভিচার অনেব বড় ঘৃণিত কাজ। যে জাতির মাঝে এহেন ঘৃণিত কাজ ছড়িয়ে পড়ে তাদের ওপর আল্লাহর লানত নাজিল হয়। অভিশপ্ত জাতিতে তারা পরিণত হয়। এমন জাতি কখনো অন্যদের ওপর বিজয় লাভ করতে পারে না।

বালআমের এই পৈশাচিক চালটি সম্প্রদায়ের খুব পছন্দ হলো। নিজের ইজ্জত-সম্মানের দিকে না তাকিয়ে মেয়েদেরকে মুসা (আ.) এর বাহিনীতে সাজিয়ে পাঠিয়ে দিলো। ইহুদিদের এক নেতা সে ফাঁদে পা দিলো। মুসা (আ.) তাকে নিষেধ করা সত্তেও সে তা থেকে বিরত হলো না। একজনের ব্যভিচারে ইহুদিদের ওপর গজব নেমে এলো। তাদের সত্তর হাজার লোক প্লেগে আক্রান্ত হয়ে এক দিনে মারা গেলো। ইহুদিরা ওই নেতা ও নারীকে হত্যা করে গাছে ঝুলিয়ে দিলো। যেন অন্যরা তা থেকে শিক্ষাগ্রহণ করতে পারে। বালআম ইবনে বাঊরাকে অনেকে মুসলমান বললেও, প্রসিদ্ধ তাবেয়ী হাসান বসরী (রাহ.) তাকে মুনাফিক আখ্যায়িত করেছেন।

বালআম ইবনে বাঊরার শাস্তি :

আল্লাহ তায়ালা যাকে ইলম-জ্ঞান দান করেন, তার উচিত সেটাকে মর্যাদা দেয়া। কেউ দুনিয়ার তুচ্ছ বস্তুকে ইলমের উপর প্রাধান্য দিলে আল্লাহ তায়ালা তার থেকে তা ওঠিয়ে নেন। এর বিপরীতে নেমে আসে আজাব। বালআম ইবনে বাঊরার ওপর যে আজাব নেমে এসেছিলো, তার বিবরণ কোরআনেই এসেছে। জিহ্বা বের হয়ে কুকুরের মতো বুকের ওপর ঝুলে থাকতো। সে অনবরত কুকুরের মতো হাঁপাতো। দুনিয়ার শাস্তি আখেরাতের তুলনায় খুবই নগণ্য। আল্লাহই তার আখেরাতের অবস্থা বলে দিয়েছেন ‘আর যাকে তিনি পথভ্রষ্ট করেন সে হবে ক্ষতিগ্রস্ত।'

ঘটনা থেকে শিক্ষা :

এক. ইবাদতকারী বড় আলেম হয়েও আল্লাহর নাফরমানিতে লিপ্ত হতে পারে। হতে পারে সিরাতে মুস্তাকিম থেকে বিচ্যুত। তাই আলেম হয়েও আল্লাহর কাছে সর্বদা দোয়া করা যেন, দ্বীনের ওপর অটল অবিচল থাকার তাওফিক দেন।

দুই. সম্পদ ও সন্তানের ব্যাপারে সতর্ক থাকা। এগুলো হচ্ছে, মানুষের মন পরীক্ষার মাধ্যম। আল্লাহ তায়ালা এগুলোর মহব্বত মানুষের মনে দিয়ে পরীক্ষা নেন যে, বান্দা কি এগুলোর মহব্বতে আমার কথা ভুলে যায় নাকি আমাকে স্মরণে রাখে? বালআম ইবনে বাঊরার মতো ব্যক্তিও স্ত্রী ও সম্পদের মোহে নিজের ঈমান আমলকে মিটিয়ে দিয়েছে। তাই ওগুলোর ব্যাপারে সতর্ক থাকা।

তিন. দ্বীনের দাওয়াতের নিয়তে খারাপ লোকের সঙ্গে সম্পর্ক রাখা ভালো। হাদিসেও এ ব্যাপারে এসেছে যে, যে বান্দা মানুষের সঙ্গে মিশে এবং তাদের দুর্ব্যবহারের ওপর ধৈর্য ধারন করে, সে ওই লোকের চেয়ে উত্তম যে মানুষের সঙ্গে মিশে না। তবে কারো যদি নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা কম থাকে। মানুষের সঙ্গে মিশলে তাদের দ্বারা প্রভাবিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে তাহলে তার জন্য না মিশাই উত্তম।

চার. অশ্লীলতা গোটা জাতির জন্য আজাবের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। যে জাতি নিজেদেরকে বিপদ থেকে মুক্ত রাখতে চায় তাদের উচিত সমাজে অশ্লীলতা ছড়াতে না দেয়া।

– দৈনিক পঞ্চগড় নিউজ ডেস্ক –