• বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ১৪ ১৪৩০

  • || ১৭ রমজান ১৪৪৫

কভিড নিয়ন্ত্রণে ‘শেখ হাসিনা মডেল’

প্রকাশিত: ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২১  

ডা. মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীল  

আমার আশপাশে এখন ভ্যাকসিন উৎসব চলছে। বাসায়, চেম্বারে—সবখানে। প্রথম প্রথম আমার আশপাশেও ভ্যাকসিন নিয়ে সন্দেহ আর সংশয়ের দোলাচাল ছিল। এমনকি আমি একেবারে শুরুর দিকে প্রথম সাড়ে পাঁচ শ জনের একজন হিসেবে ভ্যাকসিনটি নেওয়ার পরও। ইদানীং ব্যাপারটি একেবারেই অন্য রকম। একেবারেই ইউটার্ন যাকে বলে। অনুপ্রাণিত হচ্ছেন দেশের লাখো মানুষ। শুরুতে কানাঘুষা ছিল আসলেই আমরা মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার আগে ৭০ লাখ ডোজ টিকা দিতে সক্ষম হব কি না? নাকি রি-এক্সপোর্ট করা লাগবে মহামূল্যবান এই কোভিশিল্ডগুলো। এখন সেই সংশয় কেটে গেছে।

অথচ টিকা নেওয়ার শুরুতে যে বিভ্রান্তি, তা কিন্তু বাংলাদেশের বেলায় অন্তত আমার কাছে একেবারেই অপ্রত্যাশিত ছিল। কারণ আমাদের রয়েছে ভ্যাকসিন নেওয়ার দীর্ঘ ঐতিহ্য। নব্বইয়ের দশকের শেষের দিকে যখন সরকারি চাকরিতে যোগ দিয়েছিলাম, তখন এ দেশে ন্যাশনাল ইমিউনাইজেশন ঢের প্রচলন ছিল। নির্ধারিত দিনে মায়েরা সুন্দর সুন্দর শাড়ি পরে দলে দলে তাঁদের নবজাতককে টিকা দেওয়ার জন্য টিকাদানকেন্দ্রগুলোতে নিয়ে আসতেন। লাইন ধরে ধৈর্যের সঙ্গে অপেক্ষাও করতেন। চারদিকে কেমন যেন একটা ঈদ ঈদ আমেজ চলে আসত। এখন ন্যাশনাল ইমিউনাইজেশন ডে নেই; কিন্তু টিকা নেওয়ার সেই কালচারটি ষোলো আনাই অব্যাহত আছে। এখনো মায়েরা তাঁদের ছয় সপ্তাহ বয়সী নবজাতকদের টিকা দেওয়ানোর জন্য সাগ্রহে টিকাদানকেন্দ্রগুলোতে নিয়ে যান। কোথায় কোনো প্রচার-প্রচারণার দরকার পড়ে না। অনেকে বলেন, শিশুদের টিকা দেওয়ায় অভ্যস্ত বাঙালি। কিন্তু এ দেশের বড়রা টিকা নেওয়ার ব্যাপারটা ঠিকমতো হজম করে উঠতে পারেননি। সে কারণেই শুরুতে এ ধরনের সংশয়। আমার কিন্তু একেবারেই তা মনে হয় না। যে মানুষ তাঁর প্রাণের চেয়েও প্রিয় ছোট্ট সন্তানটিকে টিকা দেওয়ার বেলায় সংশয়ে ভোগেন না, তাঁর যত চিন্তা নিজের বেলায় এই যুক্তি আমার কাছে একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয়। তা ছাড়া আমি লিভারের ডাক্তারি করি। আমি জানি, এ দেশের আবাল-বৃদ্ধ-বনিতার গাঁটের পয়সা খরচ করে হেপাটাইটিস ‘বি’র তিন থেকে চারটি ডোজ টিকা নেওয়ায় কী ভীষণ আগ্রহ।

টিকা নিয়ে এ দেশে যে শুরুর দিককার অপ্রত্যাশিত সংশয় তার মূল কারণটা অন্য জায়গায়। পাশ্চাত্যেও আমরা অ্যান্টি-ভ্যাকসিন ক্যাম্পেইন দেখেছি, কিন্তু তার কারণ হচ্ছে ভ্যাকসিনের প্রতি একদল মানুষের অনাস্থা। আমাদের দেশে ভ্যাকসিন নিয়ে ঝামেলা তৈরি করা হয়েছিল একেবারেই উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে। কিছু মানুষের অসৎ উদ্দেশ্যই ছিল গণ-ভ্যাকসিনেশন প্রক্রিয়াটিকে বানচাল করে কভিডকে এ দেশে দীর্ঘস্থায়ী করে সরকারকে একটা দীর্ঘমেয়াদি সংকটে ঠেলে দেওয়া। পাশাপাশি সরকারের ওপর মানুষের তাত্ক্ষণিক অনাস্থা সৃষ্টিও ছিল তাদের বাড়তি লক্ষ্য। যে কারণে শুরু থেকেই আমরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হাজার রকমের বিভ্রান্তি ছড়াতে দেখেছি ভ্যাকসিন আসা-না আসা, আসলে পাওয়া-না পাওয়া আর পেলে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হওয়া-না হওয়া নিয়ে। বলাই বাহুল্য, শেষ পর্যন্ত দুষ্ট লোকের মিষ্টি কথায় গলেনি বাঙালির হৃদয়। সপ্তাহ না গড়াতেই ভ্যাকসিন কেন্দ্রগুলোতেই তাই উপচেপড়া ভিড়। আর ভ্যাকসিনবিষয়ক এই নিস্পৃহতাকে আগ্রহের জায়গায় নিয়ে যাওয়ায় আবারও সামনে থেকে নেতৃত্ব দিলেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। প্রথম যেদিন ভ্যাকসিনেশনের পাইলটিং করা হলো, সেদিন তিনি নিজে ভার্চুয়ালি সংযুক্ত থেকে সাহস জুুগিয়েছেন ভ্যাকসিনগ্রহীতাদের আর সঙ্গে গোটা জাতিকে। তারপর কী মন্ত্রিসভার বৈঠক, কী যুবলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী, নবনির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানই হোক কিংবা আনসার-ভিডিপির বার্ষিক কুচকাওয়াজ—সবখানেই তিনি আহ্বান জানিয়েছেন মানুষকে ভ্যাকসিন নিতে উদ্বুদ্ধ করার।

পাশাপাশি বাংলাদেশে আগেভাগে ভ্যাকসিন নিয়ে আসার অসামান্য কৃতিত্বও তাঁরই। তিনি এমন একটি ভ্যাকসিন শনাক্ত করেছিলেন, যা পেতে আমাদের সমস্যা হবে না আর পাশাপাশি যা আমাদের জন্য নিরাপদ এবং সর্বোপরি অবশ্যই কার্যকর। অ্যাস্ট্রাজেনেকার কাছ থেকে টেক-ট্রান্সফারের মাধ্যমে সেরাম ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়ার উৎপাদিত কোভিশিল্ড বেছে নেওয়ার কারণেই আজ আমাদের হাতে ভ্যাকসিনের এত বড় মজুদ। আমরা যেদিন গণটিকাদান কার্যক্রমটি আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু করলাম, সেদিন পৃথিবীর ১৫০টিরও বেশি দেশের প্রায় আড়াই শ কোটি মানুষ ভ্যাকসিনের প্রত্যাশায় গালে হাত দিয়ে অপেক্ষা করছিল। আর যেসব দেশ আমাদের অনেক আগেই ভ্যাকসিনের আগাম মূল্য পরিশোধ করে বগল বাজাচ্ছিল কিংবা এমনকি বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছিল ভ্যাকসিন ডেভেলপমেন্টে, তাদের অবস্থাও কিন্তু খুব একটা আশাব্যঞ্জক নয়। নিজ দেশের প্রতিজন নাগরিকের জন্য চার ডোজ করে আগাম ভ্যাকসিনের মূল্য পরিশোধ করেও কানাডা দিতে পেরেছে অল্প কিছু ভ্যাকসিন। সে দেশের প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো এসওএস বার্তা পাঠিয়েছেন ভারতে, নিজে ফোন করে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে অনুরোধ জানিয়েছেন কোভিশিল্ড নিয়ে তাঁর দেশের মানুষের পাশে দাঁড়াতে। এর আগে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন স্পষ্টই জানিয়ে দিয়েছেন যেহেতু তার নিজের হাতেই তার দেশের মানুষের জন্য যথেষ্ট ভ্যাকসিন নেই, কাজেই তিনি কানাডাকে কোনো ভ্যাকসিন দিয়ে সাহায্য করতে পারবেন না। ইউরোপের অবস্থাও তথৈবচ। আগাম টাকা দিয়ে ভ্যাকসিন না পেয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়ন সেখানে উৎপাদিত ভ্যাকসিন রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে, যা নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছে খোদ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও।

সেরাম ইনস্টিটিউটের কাছ থেকে না এনে আমরা যদি অ্যাস্ট্রাজেনেকার কাছে ভ্যাকসিনের জন্য ধরনা দিতাম, তাহলে আমাদের পরিণতি হতো আরো খারাপ। প্রথমত, যেহেতু আমাদের অঞ্চলে ভ্যাকসিন বিপণনের স্বত্ব তারা দিয়ে রেখেছে সেরাম ইনস্টিটিউটকে, কাজেই তারা চাইলেও আর এই অঞ্চলে ভ্যাকসিন সরবরাহ করতে পারত না। আর পারলেও নির্ধারিত সময়ে টিকা প্রাপ্তি নিয়ে সংশয় থাকত আগাম টাকা নেওয়ার পরও এই অ্যাস্ট্রাজেনেকাই ইউরোপীয় ইউনিয়নকে জানিয়ে দিয়েছে, আগাম টাকা নিয়েছে বলেই তারা নির্ধারিত সময়ে ভ্যাকসিন সরবরাহ করতে বাধ্য নয়। অন্যদিকে যখন কদিন আগেই গুজব রটানো হয়েছিল যে সেরাম ইনস্টিটিউট বাংলাদেশকে ভ্যাকসিন দেবে না, তখন বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার তো বটেই, এমনকি ভারতের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিজে মিডিয়াকে জানিয়েছিলেন, এ নিয়ে সংশয়ের কোনো কারণ নেই। ভারত যে শুধু নির্ধারিত সময়ে বাংলাদেশকে ভ্যাকসিন সরবরাহ করেছে এবং করবে তা-ই নয়, ভারতীয় উপহারের সবচেয়ে বড় ভ্যাকসিন চালানটি কিন্তু মুম্বাই বিমানবন্দর থেকে ঢাকায়ই এসেছে। ভুলে গেলে চলবে না এবারই প্রথম নয়, ভারত আর বাংলাদেশ একে অপরের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে পরস্পরের প্রয়োজনে বারবার। বাঙালি আর ভারতীয়দের রক্তের মিলিত স্রোতোধারায় যে বাংলাদেশের জন্ম, তাদের সেই সম্পর্কের গভীরতা যে অর্থ আর স্বার্থের চেয়েও অনেক গভীর, তারই নজির আমরা দেখলাম আরো একবার এই করোনাকালে।

পাশাপাশি কোভিশিল্ড যেহেতু ২ থেকে ৮ ডিগ্রি তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করা যায় এটি আমাদের ইপিআই সক্ষমতার সঙ্গে মিলে যায়। কারণ আমাদের ইপিআই কার্যক্রমে যে টিকাগুলো ব্যবহার করা হয়, সেগুলোর বেশির ভাগই এই একই তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করা হয়। পাশাপাশি কোভিশিল্ড ভারতের এক হাজার ৭০০ জন মানুষের ওপর ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে নিরাপদ বলেও প্রমাণিত হয়েছে। যেহেতু আমাদের জেনেটিক বৈশিষ্ট্যগুলো ভারতীয়দের কাছাকাছি আর একই রকম আমাদের অভ্যাস আর জীবনাচার, কাজেই এটি যে আমাদের জন্যও নিরাপদ তা তো বলাই বাহুল্য। ফাইজার কিংবা মডার্নার টিকাগুলো এসব জায়গায় কোভিশিল্ডের কাছে মার খেয়ে যায়। আমি জানি আমাদের অনেকেরই একটু দুঃখবোধ আছে বাংলাদেশে সিনোভ্যাকের ভ্যাকসিনটির ট্রায়ালটি না হওয়ায়। ভাগ্যিস হয়নি! সিনোভ্যাক যে শুধু এ দেশে ট্রায়াল করার জন্য মোটা অঙ্কের টাকাই দাবি করেছিল তা-ই নয়, ব্রাজিলে ট্রায়ালে সিনোভ্যাকের ভ্যাকসিনটির কার্যকারিতা পাওয়া গেছে মাত্র ৫০ শতাংশ, যে কারণে সিনোভ্যাকের ভ্যাকসিনটি এখন বাতিলের খাতায় আর ব্রাজিলও সিনোভ্যাক ফেলে এখন ঝুঁকেছে কোভিশিল্ডের দিকেই। আর এসব কারণেই বলছিলাম যে দেশের মানুষের জন্য সঠিক ভ্যাকসিনটি বেছে নেওয়াটা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অসীম প্রজ্ঞারই আরেক দফা বহিঃপ্রকাশ মাত্র।

আমরা সৌভাগ্যবান, কারণ আমাদের কাণ্ডারি শেখ হাসিনা। তিনি শুধু আমাদের রোল মডেল নন, পুরো পৃথিবীরই রোল মডেল আজ ‘শেখ হাসিনা মডেল’!

লেখক: অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান, লিভার বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় ও সদস্যসচিব, সম্প্রীতি বাংলাদেশ

– দৈনিক পঞ্চগড় নিউজ ডেস্ক –