• বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ১৪ ১৪৩০

  • || ১৭ রমজান ১৪৪৫

মুক্ত ভাবনা

করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলায় সরকার ও আমাদের করণীয়

প্রকাশিত: ৩০ মার্চ ২০২০  

সারাবিশ্বে করোনা ভাইরাসের প্রকোপ অনেক আগেই মহামারী আকার ধারণ করেছে। প্রতিদিন নতুন নতুন নাম যোগ হচ্ছে মৃত্যুর মিছিলে। এই ভয়ঙ্কর অবস্থা থেকে উত্তরণের আপাতত কোন সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না।

আমাদের দেশও এই ভাইরাসের ভয়াল থাবা থেকে রক্ষা পায়নি। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত- আমাদের দেশে মোট আক্রান্তের সংখ্যা ৪৮ জন, মারা গেছেন ৫ জন এবং এ পর্যন্ত সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন ১৫ জন।

খুব সম্ভবত ভৌগোলিক কারণে আমরা বাড়তি একটি সুবিধা পেয়েছিলাম। সেটা হল, পৃথিবীতে করোনাভাইরাসে আমাদের দেশ আক্রান্ত হওয়ার সিরিয়ালে ছিল সবার শেষে। অর্থাৎ প্রস্তুতি নেয়ার জন্য, অন্য যেকোনো দেশের চেয়ে আমরা সব চাইতে বেশি সময় পেয়েছিলাম। কিন্তু স্পষ্টতই আমরা এই সুযোগটার সদ্ব্যবহার করতে পারিনি। অনেকগুলো সিদ্ধান্ত আগে-পরে নেয়া হয়ে গেছে। অনেকগুলো সিদ্ধান্ত নেয়াও হয়েছে অনেক দেরিতে। যে কারণে বিদেশ ফেরতদের ব্যাপারে হোম কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিত করা যায়নি। এছাড়াও মানুষের মধ্যে শুরু থেকে উপযুক্ত জনসচেতনতা তৈরি করা যায়নি।

বিপুলসংখ্যক জনগণের মধ্যে তীব্র অসচেতনতা এবং অবহেলা তৈরি হলো যে কারণেঃ

গত বছরের ডিসেম্বরে চীনের উহানে এই ভাইরাস সংক্রমণ শুরু হওয়ার পরে, বাংলাদেশের একশ্রেণীর ইউটিউবার এবং ফেসবুকার, হাজার হাজার চ্যানেল খুলে বিপুল উদ্যমে প্রচার করা শুরু করল, এটি আল্লাহর গজব। বাংলাদেশের মানুষদের কিছুই হবেনা অথবা যারা প্রকৃত মুমিন-মুসলিম, তাদের কিছুই হবে না। এই ভাইরাসে শুধু নাস্তিক এবং কাফেররা ধ্বংস হবে। তারা এটাও বলে বেড়াতে শুরু করলো, যে ছোঁয়াচে রোগ এবং মহামারী বলতে আসলে কিছু নেই। শুধু যে তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো ব্যবহার করলো তাই না, বরং তারা কাগজের লিফলেট ছাপিয়ে সেগুলো বিতরণ করার ব্যবস্থা করল। যার ফলশ্রুতিতে পরবর্তীতে বিভিন্ন ওয়াজ মাহফিলে, বক্তারা এইসব ফেসবুক-ইউটিউবে প্রচারিত বক্তব্যের অনুরূপে বক্তব্য দেয়া শুরু করলেন। আর নিমেষে সেটা বাংলাদেশের বিপুল পরিমাণ স্বল্পশিক্ষিত মানুষের কাছে পৌঁছে গেল। সাধারণ মানুষ মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতে শুরু করলেন। অসচেতনতার শুরুটা এখান থেকেই।

ওয়াজ মাহফিলের বক্তাদের সামাজিক দায়িত্ববোধ থেকে, তারা যদি সত্যি কথাটা বলতেন এবং মানুষজনকে সচেতন করার চেষ্টা করতেন, তাহলে পরিস্থিতি এখন অনেকটাই ভালো হতো। এর সাথে এটাও বলা যায়, সরকার যদি পরিপূর্ণভাবে এবং কঠোরহাতে গুজব নিয়ন্ত্রণ করতে পারত, তাহলে হয়তো দেশের মানুষের অসচেতনতার এই জায়গাটি তৈরি হওয়ার সুযোগই হত না । দেরিতে হলেও সরকারের কিছু উদ্যোগ এবং মাঠে সেনাবাহিনীর ব্যাপক তৎপরতার কারণে পরিস্থিতি এখন অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে। তবে দেশের উদ্ভূত এই জরুরি অবস্থা নিরসনকল্পে, সরকার আরো কিছু পদক্ষেপ নিতে পারে। যেমনঃ

১) এই সামাজিক দূরত্ব মেনে চলা এবং লকডাউন এর কারণে সবচাইতে বেশী অসুবিধায় পড়েছেন নিম্নআয়ের এবং শ্রমজীবী মানুষেরা। মূলত যারা দিন আনে দিন খায়, তাদের এই মুহূর্তে উপার্জনের কোন ব্যবস্থা নেই। সে ক্ষেত্রে সরকার রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে, দেশের সকল সরকারি কর্মকর্তাদের একদিনের বেতন, এসব নিম্ন আয়ের মানুষদের মাঝে বন্টন করার সুব্যবস্থা করতে পারে। সে ক্ষেত্রে তৃতীয় শ্রেণীর কর্মকর্তা-কর্মচারীরা হিসেবের বাইরে থাকবে।

২) টিসিবির মাধ্যমে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য প্রত্যেকটি পাড়ায়-মহল্লায় ট্রাকে করে, অস্থায়ী পয়েন্টের মাধ্যমে সুলভ মূল্যে বিক্রি করার ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে কেনার ব্যাপারটা নিশ্চিত করতে হবে। তাহলে মানুষজনকে অন্তত নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিষের জন্য বাজার পর্যন্ত যেতে হবে না।

৩) এই মহামারী কে অনেকেই একটা যুদ্ধের সাথে তুলনা করছেন। এটা আসলেই একটা যুদ্ধ, ভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। বরং এই যুদ্ধ আরো বেশি মারাত্মক কারণ এখানে শত্রুরা দৃশ্যমান নয়। এই যুদ্ধে সবার আগে যারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তাঁরা হচ্ছেন ডাক্তাররা। ইতোমধ্যেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এসেছে, তারা কর্ম ক্ষেত্রে যাওয়ার ব্যাপারে, লকডাউন এর কারণে পুলিশের এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর বাধার সম্মুখীন হচ্ছেন। অনেক ক্ষেত্রে তাঁরা নিজেদের পরিচয় দেওয়ার পরেও তাদেরকে নাজেহাল হতে হয়েছে। এই ব্যাপারে প্রশাসনের সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া উচিৎ। এই দুর্দিনে যারা জীবন বাঁচানোর কাজ করছেন তাঁরা তাঁদের কর্ম ক্ষেত্রে যাওয়ার ব্যাপারে যেন কোনরকম বাধা বিঘ্নের সম্মুখীন না হন। বরং প্রশাসনের পক্ষ থেকে উচিৎ, তাঁদেরকে নিরাপদে তাঁদের কর্মস্থলে নিয়ে যাওয়া এবং সেখান থেকে নিরাপদে আবার তাঁদের বাসায় ফিরে যাওয়া নিশ্চিত করা।

৪) চিকিৎসকদের যেহেতু একেবারে সামনের সারি থেকে এই যুদ্ধ চালিয়ে নিতে হচ্ছে, সেহেতু তাঁদের নিজেদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার প্রতি সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া উচিৎ। তাঁদের যাবতীয় মেডিকেল সরঞ্জাম এবং পার্সোনাল প্রটেক্টিভ ইকুইপমেন্ট (PPE) এর পর্যাপ্ত সাপ্লাই অত্যন্ত দ্রুতগতিতে নিশ্চিত করা উচিৎ।

৫) ইতোমধ্যেই সংবাদমাধ্যমে এসেছে, বিভাগীয় পর্যায়ে বিভিন্ন জেলাগুলোতে সরকারি উদ্যোগে পিসিআর মেশিন (যেটা দিয়ে রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে ভাইরাস শনাক্ত করা যায়) পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। এটি অবশ্যই সরকারের একটি অসাধারণ উদ্যোগ- কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি, যে বেশিরভাগ হসপিটালে এই মেশিন চালানোর মত অভিজ্ঞ টেকনিশিয়ান নেই। যেখানে টেকনিশিয়ান অনুপস্থিত, সেখানে এই মেশিন বাস্তবক্ষেত্রে কোন কাজে আসবে না। কাজেই এই ব্যাপারে অন্তত একজন করে হলেও, পিসিআর মেশিনের সাথে একজন অভিজ্ঞ টেকনিশিয়ান হসপিটালগুলোতে নিয়োগ দেয়া প্রয়োজন।

৬) ইতোমধ্যে অনেক জায়গাতেই দেখা গেছে কিছু স্বার্থান্বেষী মানুষ এবং স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী, এই দুর্দিনে চরম অমানবিক এবং স্বার্থপর আচরণ করছে। তারা হসপিটাল তৈরিতে বাধা দিচ্ছে, অসুস্থ ব্যক্তির সেবার জন্য কোন সহযোগিতা করছে না, এমনকি মৃত ব্যক্তির দাফন কাফনের কাজেও তারা বাধা দিচ্ছে। সরকারের উচিৎ, এই ব্যাপারটি কঠোরভাবে নজরদারির আওতায় নিয়ে আসা এবং কোনো স্বার্থান্বেষী মহল বা ব্যক্তি যেন এ ধরনের কোন অমানবিক কাজে লিপ্ত থাকতে না পারে, সেই ব্যাপারে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া।

সবচেয়ে বড় কথা, এই যুদ্ধে জয়লাভ করার জন্য শুধু সরকার বা রাষ্ট্রযন্ত্রের দিকে তাকিয়ে থাকলে হবে না, আমাদের সবার সম্মিলিত অংশগ্রহণ প্রয়োজন। অনেক দেরিতে হলেও, বাংলাদেশের বেশ কিছু বড় বড় কোম্পানি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। তারা তাদের সাধ্যমতো সরকারের সাথে সহযোগিতা করার চেষ্টা করছে। এটি অবশ্যই একটি আশার সংবাদ। তবে এটি শুধু কর্পোরেট লেভেলে বা সরকারের ঊর্ধ্বতন লেভেলে না থেকে, ছড়িয়ে দিতে হবে ব্যক্তি পর্যায় পর্যন্ত। অর্থাৎ আমাদের সেই মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের মতো, যার যা কিছু আছে, সেটা নিয়েই সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। একমাত্র এভাবেই সম্ভব এই মহামারীর হাত থেকে বেঁচে যাওয়া। সবশেষে আল্লাহ সবাইকে ভালো রাখুন সুস্থ রাখুন এই প্রার্থনা

– দৈনিক পঞ্চগড় নিউজ ডেস্ক –