• বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ১২ ১৪৩১

  • || ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫

সর্বশেষ:
ছয়দিনের সফরে ব্যাংককে পৌঁছেছেন প্রধানমন্ত্রী গরমে ‘অতি উচ্চ ঝুঁকিতে’ বাংলাদেশের শিশুরা: ইউনিসেফ গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা: বেরোবি কেন্দ্রের পরীক্ষার্থী ৩১ হাজার ৯৪৬ জন বাংলাদেশ-ভারত ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করবে: ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী কাতারের আমিরের সফরে যা পেল বাংলাদেশ

কৃষক থেকে ধান গবেষক!

প্রকাশিত: ১ ডিসেম্বর ২০১৮  

ধৈর্য আর প্রচেষ্টা থাকলে নতুন কিছু আবিস্কার করা সম্ভব, তা-ই প্রমাণ করেছেন শেরপুরের নালিতাবাড়ীর চাটকিয়া গ্রামের কৃষক সেন্টু চন্দ্র হাজং। ধানের নতুন জাত উদ্ভাবনে পুঁথিগত বিদ্যা না থাকলেও এক যুগ ধরে একক প্রচেষ্টায় ১৯ ধরনের নতুন ধান উদ্ভাবন করেছেন তিনি। চেষ্টা চলছে আরো নতুন জাত উদ্ভাবনের।

উদ্ভাবিত নতুন ১৯ জাতের ধানের মধ্যে সাতটি ধানের নাম দিয়েছেন। এছাড়া শংকরায়নের মাধ্যমে দেশি বিলুপ্ত প্রজাতির ৩৫ প্রকার ধান একক বৈশিষ্ট্যে উন্নত করতে চাষাবাদ ও সেগুলোর বীজ তৈরি করে চলেছেন তিনি।

সেন্টুর দাবি, চিনিশাইল একরে ৩০ থেকে ৩৫ মণ ধান হয়। আর তার উদ্ভাবিত সেন্টুশাইল একরে ৫০ থেকে ৫৬ মণ ধান হয়। চিনিশাইল ধানের গাছ উচ্চতায় সাধারণত ১৬০ সেন্টিমিটার হয়। ফলে ঝড়ে বা বাতাসে ধানগাছ হেলে পড়ে। কিন্তু সেন্টুশাইল উচ্চতায় ১০০ থেকে ১২০ সেন্টিমিটার লম্বা হয়। তাই বাতাসে হেলে পড়ে না। এই ধান আষাঢ় থেকে ভাদ্রের ১৫ দিনের মধ্যে লাগাতে হয়। এ রকম প্রায় প্রতিটি নতুন উদ্ভাবিত ধানের সুফল রয়েছে।

সেন্টু হাজংয়ের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, অনেক কৃষক তার কাছে এসেছেন পরামর্শ নিতে। সামনে বোরো ধান চাষ করার প্রস্তুতি চলছে। তাই গ্রামের কৃষকরা সেন্টুর কাছে উন্নত জাতের বীজ নিতে এসেছেন। কেউবা চাহিদার তালিকা দিতে এসেছেন। এই বীজের বেশির ভাগই সেন্টু স্থানীয় কৃষকদের বিনামূল্যে দিয়ে সাহায্য করছেন।

সেন্টু হাজংয়ের বাড়ির উঠানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে নানা জাতের ধানের চারার মাটির টপ। সেন্টু বলেন, এই ধান গবেষণার কাজে ব্যাপক ধৈর্য্য প্রয়োজন। তবে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো সহায়তা করলে আরো উন্নত জাতের ধান আবিষ্কার করতে পারবো। প্রতি বছর আমার উদ্ভাবিত ধান দেশের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলার কৃষকরা এসে নিয়ে যান। তারা চাষাবাদ করে লাভবানও হয়েছেন।

চাটকিয়া গ্রামের কৃষক সতেন্দ্র বর্মন ও রুপাকুড়া গ্রামের কৃষক খোরশেদ আলম বলেন, এ বছর আমন মৌসুমে সেন্টুশাইল ধান আড়াই একর জমিতে চাষ করেছিলেন তিনি। একরে ৪৫ মণ ধান পেয়েছেন। চিকন এই ধানের বাজারমূল্য মণপ্রতি এক হাজার ৫৫০ টাকা। তাই এই ধান চাষ করে লাভবান হওয়া সম্ভব হয়েছে।

নয়াবিলের ইউপি চেয়ারম্যান ইউনুস আলী দেওয়ান বলেন, সেন্টু একজন আদর্শ কৃষক। তিনি একক প্রচেষ্টায় এক যুগ ধরে ১৯ প্রকারের নতুন ধান উদ্ভাবন করেছেন। তাকে সরকারি-বেসরকারিভাবে সহযোগিতা করতে পারলে, সে আরও ভালো করবে।

এ সম্পর্কে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ আশরাফ উদ্দিন বলেন, কিছু দেশীয় ধানগুলো সিলেকশন পদ্ধতির মাধ্যমে জাত উন্নয়নের চেষ্টা করছেন সেন্টু। ধান গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও বিনার গবেষকরা তার কর্মকান্ড পরিদর্শন করেছেন। ধান গবেষণায় তার অনেক আগ্রহ রয়েছে, আমরা তাকে সব প্রকার কারিগরি সহযোগিতা দেয়ার চেষ্টা করব।

২০০৫ সালে বেসরকারি সংগঠন ‘কারিতাস’ পাহাড়ি দরিদ্র কৃষকদের নিয়ে ‘জৈব পদ্ধতিতে চাষাবাদ ও নতুন জাতের ধান উদ্ভাবন’ শীর্ষক তিনদিনের একটি প্রশিক্ষণ কর্মশালার অংশ নেন তিনি। সেখানে ফিলিপাইনের একজন ধান গবেষক বিভিন্ন এলাকার ১৬ জন কৃষককে প্রশিক্ষণ দেন। সেই অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে নতুন ধান সৃষ্টি করার জন্য কয়েক দফা চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। কিন্তু দমে যাননি বলে জানান তিনি।

ধান উদ্ভাবনের সামান্য অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে ধৈর্য্য সহকারে নতুন ধানের জাত সৃষ্টি করার জন্য প্রতি বছর পরীক্ষামূলকভাবে মাটির টবে ধান শংকরায়ন করে তা বীজ হিসেবে সংরক্ষণ শুরু করেন। সেই বীজ পর্যায়ক্রমে চাষাবাদ করে ১৯ প্রকারের নতুন ধানের জাত উদ্ভাবন করেছেন।

সেন্টু হাজং বলেন, বেলা তিনটা থেকে পাঁচটার মধ্যে ধানগাছের অর্ধেক শীষ আসার সময় ব্রিডিং বা শংকরায়ন করতে হয়। প্রথমে একটা শীর্ষ ধানের মাঝখান দিয়ে আড়াআড়ি করে কাঁচি দিয়ে কাটতে হয়। প্রতিটা ধানের মাঝে ছয়টি রেণু থাকে। পরে কাটা ধান (মা ধান) থেকে সুঁচ দিয়ে যত্ন সহকারে রেণু বের করে পরের দিন সকাল ১০টা থেকে ১২টার মধ্যে পরাগায়ন করার জন্য অন্য জাতের ধানের (বাবা ধান) রেণু এনে মা ধানের ওপর ঝাঁকিয়ে দিয়ে মোটা কাগজ দিয়ে বেঁধে রাখতে হয়।

উদ্ভাবিত জাতগুলো খুবই আবহাওয়া সহিষ্ণু। একেকটা জাত বিভিন্ন সময়ে পাকে। এরমধ্যে কতগুলো ১১০ দিনে, কতগুলো ১২০ দিনে, কতগুলো ১৩০ দিনে বা ১৩৫ দিনে পাকে। এ সময় শংকরায়ন করা ধানে পরিপুষ্ট চাল হয়। এই ধান বীজ হিসেবে সংরক্ষণ করেন সেন্টু। এভাবে ১২ বছর গবেষণা করে ১৯ প্রকারের নতুন ধানের জাত তৈরি করেছেন তিনি।

তখন সবচেয়ে ভালো ফসল ও ধান গাছের উচ্চতা বিবেচনা করে সেই ধানের বীজ সংরক্ষণ করেন। এইভাবে পর্যায়ক্রমে সেন্টু হাজং উদ্ভাবিত নতুন ধানের বীজ বৃদ্ধি করেছেন। একই পদ্ধতিতে বিলুপ্ত ৩৫টি দেশি জাতের ধানের বীজ পলিথিন, কৌটা ও ধানের ছড়া বেঁধে সংরক্ষণ করেছেন।

চিনিশাইল, তুলসিমালা, চাপাল, পাইজাম, বাইশমুঠি, হরি, স্বর্ণলতা ও রঞ্জিত ধানের সঙ্গে শংকরায়ন করে নতুন জাতের ধানের বীজ উদ্ভাবন করেছেন তিনি। তবে এখনও এইসব ধানের কোনো নাম দেয়া হয়নি।

সেন্টু হাজং মনে করেন, ফসলের মাটি ভালো রাখতে এবং ভালো ধান পেতে হলে জৈব পদ্ধতিতে তৈরি সার ও কীটনাশক ব্যবহার করা উচিত। তাই তিনি বাজার থেকে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক কিনে ফসলে দেন না বললেই চলে। তিনি নিজের তৈরি করা জৈব সার ও কীটনাশক ব্যবহার করেন। এ জন্য কেঁচোর বিষ্ঠায় কম্পোস্ট সার ও নিমপাতা, মেহগনির বিচি, আতাফলের পাতা দিয়ে জৈব পদ্ধতিতে কীটনাশক তৈরি করেন। এই কীটনাশক ব্যবহারে ভালো ফসল যেমন পাওয়া যায়, তেমনি রাসায়নিক সার কেনার টাকাও বেচে যায়।

সেন্টু হাজংয়ের উদ্ভাবনের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০১৭ সালের ৬ মে ইস্টল্যান্ড ইনস্যুরেন্স কোম্পানি ঢাকা আর্মি গলফ গার্ডেনের হলরুমে তাকে ক্রেস্ট উপহার দেন এবং সন্মানীস্বরূপ এক লাখ টাকা প্রদান করে।

এছাড়াও সম্প্রতি ধান গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিনার গবেষকরা সেন্টু হাজংয়ের কর্মকাণ্ড পরিদর্শন করে আরো উন্নত গবেষণার জন্য তার উদ্ভাবিত ধানের বীজ নিয়ে যান। গবেষকরা সেন্টুকে সব ধরনের সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন।

– দৈনিক পঞ্চগড় নিউজ ডেস্ক –