• শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ১৫ ১৪৩০

  • || ১৮ রমজান ১৪৪৫

জনগণের উন্নয়ন ছাড়া দেশের উন্নয়ন সম্ভব নয়- প্রধানমন্ত্রী

প্রকাশিত: ২৭ জানুয়ারি ২০২০  

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, তৃণমূলে জনগণের আর্থসামাজিক উন্নয়ন ছাড়া কখনো একটি দেশের সার্বিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। একটা দেশের সার্বিক উন্নয়ন করতে হলে শুধু রাজধানী ভিত্তিক উন্নয়ন করলেই হবে না, একেবারে গ্রামের মানুষ, তৃণমূলের মানুষদের উন্নতি করতে হবে।
শনিবার সকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে দুটি পানি শোধন প্রকল্প, দুটি সেতু ও কয়েকটি ট্রেন সার্ভিসসহ বেশ কিছু উন্নয়ন প্রকল্প উদ্বোধনের সময় এসব কথা বলেন।

প্রকল্পগুলোর মধ্যে রয়েছে- বাংলাদেশ রেলওয়ের ঢাকা-বঙ্গবন্ধু সেতু ও পূর্ব-তারাকান্দি-জামালপুর-ঢাকা রুটে একজোড়া নতুন আন্তঃনগর ট্রেন ‘জামালপুর এক্সপ্রেস’, ঢালারচর-পাবনা-রাজশাহী রুটে ‘ঢালারচর এক্সপ্রেস’ ও ফরিদপুর রুটে ‘রাজবাড়ী এক্সপ্রেস’ ট্রেনের রুট বর্ধিতকরণ, চট্টগ্রাম-সিলেট-চট্টগ্রাম রুটে উদয়ন ও পাহাড়িকা এক্সপ্রেস ট্রেনের র‌্যাক পরিবর্তন কার্যক্রম।

প্রধানমন্ত্রী এ সময় পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের ডিজিটাল আর্থিক সেবা প্রদানের জন্য মোবাইল অ্যাপস ভিত্তিক ‘পল্লী লেনদেন’ কার্যক্রম, এলজিইডি'র বাস্তবায়নাধীন ‘গুরুত্বপূর্ণ ৯টি ব্রিজ নির্মাণ’ শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর উপজেলায় ১৫ হাজার মিটার চেইনেজে তিতাস নদীর ওপর ৫৭৫ মিটার দীর্ঘ পিসি গার্ডার সেতু এবং মানিকগঞ্জের সদর উপজেলাধীন মানিকগঞ্জ-সিঙ্গাইর আরএইচডি রাস্তায় কালীগঙ্গা নদীর ওপর ৪৫৬ মিটার পিসি গার্ডার সেতু উদ্বোধন করেন।
 
এছাড়া চট্টগ্রাম ওয়াসার চট্টগ্রাম পানি সরবরাহ উন্নয়ন ও স্যানিটেশন প্রকল্পের (১ম সংশোধিত) আওতায় নির্মিত ‘শেখ রাসেল পানি শোধনাগার’, খুলনা ওয়াসার ‘খুলনা পানি সরবরাহ প্রকল্প’-এর আওতায় নবনির্মিত ‘বঙ্গবন্ধু ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট’ ও বাংলাদেশ টেলিভিশন চট্টগ্রাম কেন্দ্রের ১২ ঘণ্টা অনুষ্ঠান সম্প্রচার কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী।

এসময় প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশের উন্নয়ন ও মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন করাই হলো বর্তমান সরকারের মুখ্য উদ্দেশ্য। এ কারণে সারাদেশে বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ত্বরান্বিত করা হচ্ছে। শহর ও গ্রামের মানুষকে সমান সুযোগ তৈরি করে দিতে সরকার কাজ করছে।

সূচনা বক্তব্য শেষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা টুঙ্গিপাড়া পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের উপকারভোগী, চট্টগ্রামের পানি শোধনাগারের উপকারভোগী, খুলনা পানি শোধনাগারের উপকারভোগী, চট্টগ্রামে টেলিভিশনের উপকারভোগী ও জামালপুরের রেল ব্যবহারকারীদের সঙ্গে সরাসরি ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে মতবিনিময় করেন।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমাদের স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন। তার ২৪ বছরের সংগ্রাম এবং মুক্তিযুদ্ধের মহান বিজয়ের মধ্যদিয়ে আমরা স্বাধীন দেশ পেয়েছি। তিনি চেয়েছিলেন বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষ অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা এবং চিকিৎসা পাবে। স্বাধীনতার পর জাতির পিতা যে সংবিধান দিয়ে গেছেন তাতে সবার এই মৌলিক সুবিধাগুলো নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে।
 
জাতির পিতা হত্যাকাণ্ডকে একটি ‘কালো অধ্যায়’ আখ্যায়িত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, মিলিটারি ডিক্টেটররা যখন ক্ষমতায় আসে তখন নিজেদের নিয়েই ব্যস্ত থাকে। আর নিজেদের ক্ষমতার ভিত্তিটাকে শক্ত করার জন্য সমাজে একটি এলিট শ্রেণি তৈরি করে। সাধারণের জন্য কিছু করে না। যে কারণে ’৭৫’র পর এদেশের মানুষ সর্বক্ষেত্রে বঞ্চিত ছিল। আর আমরা যারা রাজনীতি করি তাদের লক্ষ্যই থাকে জনগণের কল্যাণ, তাদের সার্বিক উন্নতি।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতির পিতার দিয়ে যাওয়া সংবিধানের ১৩ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী গ্রামীণ জনগণকে সঙ্ঘবদ্ধ করে সমবায় ভিত্তিক কৃষিকে উৎসাহিত করাই তার সরকারের ‘আমার বাড়ি আমার খামার’ প্রকল্পের লক্ষ্য।

এ সময় প্রধানমন্ত্রী ক্ষুদ্র ঋণের ক্ষতিকর প্রভাব তুলে ধরে বলেন, এক সময় আমিও ক্ষুদ্রঋণে উৎসাহিত করতাম কিন্তু দেখা গেল ঋণের পরিমাণ এক সময় এত বেড়ে যায় যে, এক সময় মানুষ ঋণগ্রস্ত হয়ে আত্মহত্যা করে, না হয় ঘর-বাড়ি, ভিটে-মাটি বিক্রি করে একেবারে নিঃস্ব হয়ে যায়। সে আর নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে না।

টেকসই উন্নয়নের জন্য কখনোই এই ক্ষুদ্র ঋণ কার্যকর হয় না উল্লেখ করে তিনি বলেন, কাজেই একটা মানুষ যাতে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে, সেদিকে লক্ষ্য রেখেই ক্ষুদ্র ঋণের পরিবর্তে তার সরকার ক্ষুদ্র সঞ্চয় ভিত্তিক প্রকল্প হিসেবে একটি বাড়ি একটি খামার (বর্তমানে আমার বাড়ি আমার খামার) প্রকল্প শুরু করে। অর্থাৎ কৃষিভিত্তিক উৎপাদনের বাজারজাত হবে সমবায় ভিত্তিক।
 
প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করেন, দরিদ্রদের সঞ্চয় সুরক্ষিত রাখার জন্যই তার সরকার ‘পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক’ চালু করেছে। তিনি প্রবাস গমনেচ্ছু এবং নবীন উদ্যোক্তাদের সুবিধার্থে তার সরকারের প্রতিষ্ঠিত ‘কর্মসংস্থান’ ব্যাংকের নানা দিক তুলে ধরেন। তিনি বলেন, তার সরকারের সময় মোবাইল ফোনকে বেসরকারি খাতে উন্মুক্ত করে দেয়ার ফলে সারাদেশের সবার হাতে মোবাইল ফোন চলে এসেছে।

এ সময় শেখ হাসিনা দেশের সাড়ে ৩ হাজার ইউনিয়নে ইন্টারনেট ব্রডব্যান্ড সেবা পৌঁছে দেয়া, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ মহাকাশে উৎক্ষেপণসহ তথ্য প্রযুক্তি খাতে তার সরকারের সাফল্য তুলে ধরেন।

রেল যোগাযোগের উন্নয়নে তার সরকারের পদক্ষেপগুলো উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, পাবনা, ঢালারচর, জামালপুরসহ আরো বিভিন্ন স্থানে রেলওয়ে যোগাযোগ নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছি। রেলের মাধ্যমে মানুষ যেমন নিরাপদে যেতে পারে আবার যাতায়াতও সাশ্রয়ী হয়। সে কারণে আমরা রেল সার্ভিসের ওপর অনেক গুরুত্ব দিয়েছি। এই ক্ষেত্রে রেলওয়ের কাছে আমার একটা অনুরোধ থাকবে, আমরা রেল লাইন বাড়াচ্ছি ও নতুন নতুন বগি এবং যাত্রী পরিবহনের সুযোগ সৃষ্টি করে দিচ্ছি। তবে, রেলের পুরনো ব্রিজগুলো ও কালভার্টের ওপর ব্রিজসহ বিভিন্ন রেল ব্রিজগুলো মেরামত করতে হবে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, এগুলো অত্যন্ত পুরনো হয়ে যাওয়ায় রেল চলাচলে বিঘ্ন সৃষ্টিসহ যাত্রী নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়ছে। তিনি উল্লেখ করেন, পূর্ববর্তী সরকারের (বিএনপি) আমলে রেল বন্ধ করে দেয়ায় এমনটি হয়েছে। সে সময়কার সরকারের এটি একটি আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত ছিল বলে জানান শেখ হাসিনা।

যে কারণে বছরের পর বছর চলে গেছে এসব ব্রিজ মেরামত করা হয়নি। তারা গোল্ডেন হ্যান্ডশেকের মাধ্যমে রেলের লোকবলকে বিদায় করে দিয়েছে এবং বিভিন্ন জায়গার লাইন বন্ধ করে দিয়েছে। সারাদেশে সার্ভে করে যেখানে যত পুরনো রেল ব্রিজ আছে সেগুলো মেরামত করতে হবে, যোগ করেন প্রধানমন্ত্রী। এ জন্য একটা প্রকল্প গ্রহণ করতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।

শেখ হাসিনা বলেন, ক্ষমতায় আসার পর আমরা অনেক পানি শোধনাগার করেছি। উপজেলা পর্যায়ও আমরা পানি শোধনাগার করেছি। অনেক টাকা খরচ করে পানি শোধন করে সেই পানি সরবরাহ করা হয়। বিশেষ করে নোনা পানির জন্য খুলনাবাসীর পানির অভাব তীব্র ছিল। আমার একটা অনুরোধ থাকবে, পানি ব্যবহারের সময় যেন সবাই মিতব্যয়ী হই।
 
তিনি আরো বলেন, তাদের কষ্ট লাঘবের জন্য মধুমতি নদী থেকে পানি এনে শোধন করে খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। ১ লিটার পানি শোধন করতে প্রচুর টাকা খরচ হয়। কাজেই পানির অপচয়টা সবাই বন্ধ করবেন। কল ছেড়ে দিয়ে ব্রাশ করা, সেভ করা বা কল ছেড়ে দিয়ে গোসল করা-এগুলো কেউ করবেন না। প্রয়োজনে বালতি ও মগ ব্যবহার করবেন।

বিভিন্ন স্থানে সেতু নির্মাণের কথা উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, যোগাযোগের সুবিধার জন্য আমরা বিভিন্ন জেলায় সেতু নির্মাণ করে দিচ্ছি। যোগাযোগের ফলে প্রতিটি অঞ্চলে অর্থনৈতিকভাবে উন্নতি হচ্ছে। হরিরামপুর মানিকগঞ্জ এমন একটি এলাকা যেখানে সামান্য বৃষ্টি হলেই বন্যা হতো। সবসময় এখানে বন্যা লেগেই থাকত। এখানে যোগাযোগের ব্যবস্থা খুব অনুন্নত ছিল। সেখানে আমরা ব্রিজ করে উন্নত যোগাযোগের ব্যবস্থা করেছি।

তার সরকার জনগণের বিনোদন ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটিয়েছে উল্লেখ করে সরকার প্রধান বলেন, চট্টগ্রামে বিটিভির সম্প্রচারের সময় বাড়ানোর উদ্দেশ্যটা হলো, চট্টগ্রামে বিভিন্ন উপজাতি গোষ্ঠী রয়েছে। তাদের কালচারাল অনুষ্ঠানগুলো মানুষ দেখতে পারবে। সেখানে স্কুল-কলেজের ছেলে-মেয়েরাও বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে পারবে। প্রতিটা মানুষের ভেতরে যে সুপ্ত মেধা রয়েছে সেই প্রতিভার বিকাশ ঘটবে এই টেলিভিশন কেন্দ্রের মাধ্যমে। এছাড়া এখানে অনেকের কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে।

তিনি বলেন, আজ এখানে বসে আমরা রেল যোগাযোগ, পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক, ব্রিজ নির্মাণ, শেখ রাসেল পানি শোধনাগার, বঙ্গবন্ধু ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্টসহ কয়েকটি প্রকল্পের উদ্বোধন করলাম। এখানে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এবং বিভাগের কর্মকর্তারা উপস্থিত থেকে দেখলেন যে, কোন মন্ত্রণালয়ের কী উন্নয়ন হয়েছে। এতে উন্নয়নের দিকগুলো জানার একটা সুযোগ হলো। এসময় মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন, আ হ ম মুস্তফা কামাল, পররাষ্ট্র মন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোমেন, তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, এলজিআরডি ও সমবায় মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম, রেলপথ মন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন এবং সাবেক কৃষিমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য বেগম মতিয়া চৌধুরী।

প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউসের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব হেলাল উদ্দিন আহমেদ, রেলপথ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. মজিবুর রহমান, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. আসাদুল ইসলাম, তথ্য সচিব কামরুন্নাহার তাদের মন্ত্রণালয় ও বিভাগের বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের চিত্র তুলে ধরেন।

এছাড়াও পিএমও সচিব মো. তোফাজ্জ্বল হোসেন মিয়া, প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিমসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত, কূটনীতিক ও উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার প্রতিনিধিরা অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।

– দৈনিক পঞ্চগড় নিউজ ডেস্ক –