• শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ৭ ১৪৩১

  • || ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

সর্বশেষ:
বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার অন্যতম নকশাকার বীর মুক্তিযোদ্ধা শিব নারায়ণ দাস, আজ ৭৮ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেছেন। বন্যায় দুবাই এবং ওমানে বাংলাদেশীসহ ২১ জনের মৃত্যু। আন্তর্জাতিক বাজারে আবারও বাড়ল জ্বালানি তেল ও স্বর্ণের দাম। ইসরায়েলের হামলার পর প্রধান দুটি বিমানবন্দরে ফ্লাইট চলাচল শুরু। ইসরায়েল পাল্টা হামলা চালিয়েছে ইরানে।

মুমিনের অন্তরে অতীত-বর্তমানের হিসাব

প্রকাশিত: ১১ আগস্ট ২০২১  

যখন আমি লিখতে বসেছি তখন আমার মাথায় কোনো বিষয় ছিল না। কিন্তু আমি দেয়ালে ঝুলন্ত ক্যালেন্ডারের দিকে তাকালাম এবং বিষয় খুঁজে পেলাম। বিষয় পহেলা মহররম। আপনাদের পহেলা মহররম কি সেভাবে কেটে যায়, যেভাবে কেটে যায় বছরের অন্য দিনগুলো? অথচ এই দিনের প্রথম প্রহরে একটি নতুন বছরের জন্ম হয়। একজন মুসাফির গন্তব্যের পথে একটি দূরত্বসীমা অতিক্রম করার পর যাত্রা বিরতি দেয়, বিশ্রামের জন্য থেমে যায়। সে পেছন ফিরে দেখে কতটুকু পথ অতিক্রম করেছে, আর হিসাব করে, কতটুকু পথ রয়ে গেছে। একজন ব্যবসায়ীর একটি বছর শেষ হয়। তারপর সে তার পণ্যগুলো হিসাব-নিকাশ করে; সে হিসাব করে তার অর্জন কতটুকু। সে জানতে চায় তার কতটুকু লাভ হয়েছে কিংবা কতটুকু লোকসান।

আমরা একটি নতুন লগ্নে অবস্থান করছি এবং আমরা জীবনের পথে এগিয়ে যাচ্ছি। আরো একটি বছর জীবন থেকে চলে গেল! আমরা কি একটু সময়ের জন্য থামব না, যেখানে একটু ভাবব; চিন্তা করব, হিসাব মেলাব আর করব পর্যালোচনা।

আজ আমরা ১৩৮৬ হিজরির পহেলা মহররমে দাঁড়িয়ে (এখন শুরু হচ্ছে ১৪৪৩ হিজরি) যদি প্রত্যুষে আমরা তার দিকে মনোনিবেশ করি, তাহলে দেখব আমাদের সামনে একটি দীর্ঘদিন পড়ে আছে। তাতে আমরা যা করতে চাই তা করতে পারব। চাইলে উপভোগ করতে পারব দুনিয়া। আমাদের ইচ্ছা হলে পরকালের পাথেয় সঞ্চয়ে নিয়োজিত হতে পারব। কিন্তু যখন সন্ধ্যা নেমে আসে এবং দিন নিঃশেষ হয়ে যায়, তখন আমরা চাইলেও এই দিন থেকে কিছু অর্জন করা কিংবা তা ভোগ-উপভোগ করা আর সম্ভব হবে না। আমরা ভাবি, পুরো দিন বাকি! তাই কিছু সময় অপচয় করি—যেভাবে অপচয়কারী তার সম্পদ বিনষ্ট করে, আমরাও সময়গুলো নষ্ট করে ফেলি। অথচ তা হারিয়ে ফেললে আর আমরা ফিরে পাব না। কেননা, তা একবার শুরু হলে নিঃশেষই হয়ে যাবে। যা একবার চলে যায় তা আর কোনোভাবে ফিরে আসে না।

গত বছরের পহেলা মহররমের কথা স্মরণ করুন! পঁচাশির মহররম! সে দিনও আমরা দেখেছি, বিস্মৃত একটি দিনকে আমরা স্বাগত জাানিয়েছিলাম। আমরা তাতে বহু কল্যাণ কাজ করতে পারতাম। কিন্তু আজ সেই দিন কোথায়? কোথায় তার আগের বছর চুরাশির পহেলা মহররম? কোথায় সেসব পহেলা মহররমগুলো, যা আমরা অতিক্রম করে এসেছি কিংবা আগে আমাদের থেকে অতিক্রান্ত হয়েছে? আমাদের হাতে তার কী ফলাফল অবশিষ্ট আছে?

একটি বছর চলে যায় আর আরেকটি বছর আসে। যে ব্যক্তি এ বছর কোনো ভালো কাজ করেনি, সে যেন আগত বছর তা করে। যদি দিনের বেলা কল্যাণ অর্জন করার সুযোগ হাত ছাড়া হয়ে যায়, তাহলে রাত তার পশ্চাতে এগিয়ে আসছে। সে সময় আপনি নেক কাজ করুন। মৌসুমের পর মৌসুম এগিয়ে আসে। যদি একটি মৌসুম আপনি বিনষ্ট করে ফেলেন, তাহলে আগত মৌসুমে ফসল বুনুন। আপনি যদি জুন সেশনে পরীক্ষায় অকৃতকার্য হন, তাহলে সেপ্টেম্বর সেশনের সুযোগ নিন। এভাবে একের পর এক সুযোগ আসতে থাকবে, আপনি যত দিন বেঁচে থাকবেন। কিন্তু আপনি কি জানেন! কতকাল বেঁচে থাকবেন?

বছর পার হয়ে যায় আর আপনি ভাবছেন আপনি বেঁচে আছেন; অথচ বাস্তবে আপনি মরে গেছেন! এ কথা শুনে আপনারা বিস্মিত হবেন না। আমাকে সুযোগ দিন, দৃষ্টান্ত দিয়ে আমি তা ব্যাখ্যা করছি : ‘আপনি যেন এমন একজন কর্মজীবীর মতো, যার মাসিক বেতন হয় দৈনন্দিন ভিত্তিতে। যখন তার থেকে ১০ দিন কর্মহীন কেটে যায় আর সে শ্রমিক এ ১০টি দিনের মাইনে থেকে বঞ্চিত হয়, তখন মাসটি পরিণত হয় ২০ দিনের। যদি এভাবে ২০ দিন কেটে যায়, তাহলে মাসটি হয়ে পড়ে ১০ দিনের। মাস শেষে বেতন এমনভাবে নিঃশেষ হয়ে যায়, যেন তা ছিল না।’

আপনি কি মনে করছেন আমি দর্শন আলোচনা করছি? না, আল্লাহর কসম! বরং আমি বাস্তবতা বিশ্লেষণ করছি। যখন আমাদের কোনো একজনের বয়স এক বছর যোগের হিসেবে বেড়ে যায়, প্রকৃতার্থে তার জীবন থেকে একটি বছর কমে যায়। এভাবে বয়স নিঃশেষ হয়ে যায় এবং জীবনাবসান ঘটে। আমরা আরেক জীবনকে স্বাগত জানাই, যা মৃত্যু দিয়ে শুরু হয়।

আমি আমার ‘হূদয়ের কথন’ বইটি খুললাম এবং তার একটি পরিচ্ছেদ পড়লাম, যা ১৯৩৮ সনের শুরুর দিকে ‘আর-রিসালা’ পত্রিকার একটি বিশেষ সংখ্যায় ‘ত্রিশের দ্বারে’ শিরোনামে প্রকাশিত হয়েছিল। যদি আমি সেদিন কল্পনা করতাম যে আমি অবশ্যই ১৯৬৬ সনের শুরুতে তা পড়ব, তাহলে আমার চোখে তা হতো একটি দীর্ঘ সময়। ২৮টি বছর! আমি এখন তার দিকে তাকিয়ে আছি তা অতিক্রান্ত হওয়ার পর। এটা যেন একটি মাত্র দিন-রাত। যদি আমি আরো ২৮ বছর পর ১৯৯৪ সনের দিকে তাকাই, অবশ্যই তা আমার কাছে দূরত্বে; অথচ এ নিবন্ধ একদিন এমন একজন পাঠক পড়বে, সে দেখবে আমাদের এ বছরটিও যেন গতকাল ছিল।

এভাবে আমরা আশায় আশায় ভবিষ্যত্ বিস্মৃত করি।

কী সে ভবিষ্যত্, যার জন্য আমরা অবিরাম প্রচেষ্টারত এবং যার কারণে আমরা ক্লান্ত-শ্রান্ত! যখন আমি একজন শিক্ষার্থী ছিলাম, তখন আমার ভবিষ্যত্ ছিল সনদ অর্জন; যখন তা অর্জন করলাম, তখন লক্ষ্য হয়ে গেল চাকরিতে নিয়োগ পাওয়া। তারপর যখন তাও সাধিত হলো, তখন ক্রমে ভবিষ্যত্ হয়ে দেখা দিল সংসার করা, বাড়ি নির্মাণ ও সন্তান লাভ করা। তারপর যখন আমার বাড়ি, স্ত্রী, সন্তান, পৌত্র-পৌত্রি হয়ে গেল ভবিষ্যত্ রূপান্তির হলো উন্নয়ন, উচ্চ মর্যাদা লাভ, সম্পদের অট্টালিকা, সামাজিক প্রসিদ্ধি ও মর্যাদা লাভে, বই পুস্তকে এবং প্রবন্ধে-নিবন্ধে। যখন এসব কিছু আল্লাহর একান্ত করুণায় অর্জিত হয়ে গেল, আমার আর এমন কোনো ভবিষ্যত্ থাকল না, যা নিয়ে ভাবতে পারি। যদি না আল্লাহ তাআলা আমার দৃষ্টি আলোকিত করতেন; আমাকে পথ দেখিয়ে দিতেন; অতঃপর আমি অবশিষ্ট ভবিষ্যত্ আখিরাতের জন্য কাজ করতে পারছি; নিশ্চয়ই আমি এ থেকে অমনোযোগী ছিলাম।

ভবিষ্যত্ এমন একটি বিষয়, পৃথিবীতে যার কোনো অস্তিত্ব নেই; এটা এমন একটি দিন যা কখনো আসবে না। কেননা, তা এসে বর্তমানে রূপান্তরিত হয় আর তার অনুসন্ধানী আরেকটি ভবিষ্যত্ খুঁজতে শুরু করে এবং তার পেছনে ছুটে। এটা যেমন আমি একবার বলেছিলাম ঝুলন্ত তৃণ লতার মতো, যা ঘোড়ার জিনপুশের সঙ্গে একটি ছড়ি দিয়ে বাঁধা থাকে আর প্রাণীটির চোখের সামনে তা উঁকি দিতে থাকে। সে তার কাছে পৌঁছানোর জন্য দৌড়ে যায় এবং সেই সঙ্গে তাও দৌড়ে যায়। নির্বোধ প্রাণী কখনোই তা উপলব্ধি করতে পারে না। প্রকৃত ভবিষ্যত্ পরকালে। আমাদের মধ্যে কোথায় সে জন, যে তা নিয়ে কাজ করে? কোথায় সে জন, যে এটা নিয়ে ভাবে?

‘সুওয়ারুন ওয়া খাওয়াতিরুন’ গ্রন্থ থেকে ড. মুহাম্মদ তাজাম্মুল হক-এর ভাষান্তর

– দৈনিক পঞ্চগড় নিউজ ডেস্ক –