• শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ১৫ ১৪৩০

  • || ১৮ রমজান ১৪৪৫

সর্বশেষ:
বাংলাদেশকে হুমকির মুখে ফেলেছে ক্রমবর্ধমান জলরাশি: গবেষণা উত্তরবঙ্গের মহাসড়কে চার লেন চালু, ঈদযাত্রা হবে স্বস্তির সব উন্নয়ন সহযোগীদের এক প্ল্যাটফর্মে আসা প্রয়োজন: পরিবেশমন্ত্রী বিডিএস ভূমি ব্যবস্থাপনায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনবে: ভূমিমন্ত্রী বিএনপির নিগৃহীত নেতাকর্মীদের তালিকা দিতে হবে: ওবায়দুল কাদের

মেঘের রাজ্যে হারিয়ে যাওয়ার দিন

প্রকাশিত: ১০ ডিসেম্বর ২০১৮  

আজ বলবো মেঘের গল্প। কোথা থেকে শুরু করবো আর কোথায় শেষ করবো তা ভেবেই পাচ্ছি না। মেঘ মানেই মেঘালয়। আর মেঘালয় মানেই মেঘ। আমরা গিয়েছিলাম পাহাড়ের একেবারে চূড়ায়। সেখানে বিশাল এলাকাজুড়ে সরকারিভাবে গড়ে উঠেছে ইকো পার্ক। পার্কে ঢুকে কোনদিকে যাবো বুঝতে পারছিলাম না। চারপাশে হালকা মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে। মনে হচ্ছিল আমরা কুয়াশার মাঝে দাঁড়িয়ে আছি।

অনুমানের উপর ভিত্তি করে সামনের দিকে হাঁটতে শুরু করলাম। মেঘের ভেতর হাঁটছি। সে এক দারুণ অনুভূতি। হঠাৎ দেখলাম সামনে রেলিং দেখা যাচ্ছে, সেখানে অনেক মানুষের ভিড়। আমরা কৌতূহলী হয়ে এগিয়ে গেলাম। তারপর যা দেখলাম তা বর্ণনা করা সত্যিই আমার সাধ্যের বাইরে। রেলিংয়ের পর পাহাড়টা শেষ হয়ে গেছে। আমাদের সামনে বিশাল এলাকাজুড়ে গভীর খাদ। 

কয়েকশ ফুট নিচ পর্যন্ত আবছা দেখা যাচ্ছে। খাদের ওপারে আরেকটা পাহাড়ের ঢাল খাঁড়াভাবে নিচে নেমে গেছে। এরকম অসাধারণ সুন্দর খাড়া পাহাড়ি ঢাল এই প্রথম দেখলাম। এ যেন রূপকথার জগৎ। চিমটি কাটলেই ঘুম ভেঙে যাবে। আর কতক্ষণের জন্য সেই পাহাড়টি ঢালটিকে দেখতে পারলাম জানেন? মাত্র কয়েক মিনিট। তারপরই ঘন মেঘের আড়ালে সামনের সবকিছু আড়াল হতে শুরু করলো। আর তখনই ঘটলো এক অদ্ভুত ঘটনা। ঢালের একটি খাঁজে হঠাৎ দেখি একটি সুন্দর দোচালা বাড়ি। মুহূর্তের মধ্যে সেই বাড়ির নিচে মেঘ চলে আসলো। মনে হচ্ছিল বাড়িটা মেঘের উপরে। ঠিক যেন রূপকথার জ্যাক ও শিম গাছ গল্পের দৈত্যের বাড়ি। শিম গাছ বেয়ে এখুনি জ্যাক এই বাড়িতে আসবে। মাত্র কয়েক সেকেন্ড। তারপর বাড়িটাও মেঘের আড়ালে হারিয়ে গেলো। সেই অসাধারণ সুন্দর পাহাড়ি ঢাল, রূপকথার বাড়ি কোনোকিছুই ভালো করে দেখতে পারলাম না। ছবি তোলাতো অনেক পরের কথা। সামনে আমাদের তখন শুধু আদিগন্ত মেঘ আর মেঘ।

এরপরের পুরো সময়জুড়েই মেঘ আমাদের সঙ্গী হয়ে রইলো। দুই-তিন হাত দূরের জিনিসও ঝাপসা দেখা যাচ্ছে। ইকো পার্কটিতে শিশুদের একটা খেলার জায়গা আছে। কন্যা প্রমিতি মেঘের মধ্যে দোলনায় দুললো, স্লিপ খেললো। ইকো পার্কটির ভেতর ওয়াটার হার্ভেস্টিং কাঠামো গড়ে তোলা হয়েছে। সেখানে প্রচুর পানি নদীর আকারে প্রবাহিত করার ব্যবস্থা করা আছে। পাহাড়ের কিনারার একটি অংশ দিয়ে এই পানির ধারা ঝরনা হয়ে নিচে নেমে গেছে। ঠিক যে জায়গায় ঝরনাটির শুরু সেখানে একটা সেতু আছে।

একটু কল্পনা করে দেখুন আপনি পাহাড়ের চূড়া থেকে শুরু হওয়া একটা ঝরনার ঠিক উৎপত্তিস্থলের উপরে দাঁড়িয়ে আছেন, কি দারুণ ব্যাপার। কিন্তু পুরো জায়গাটা মেঘে ঢাকা থাকায় সেতু থেকে নিচের কিছুই দেখার উপায় নেই। আমরা সেদিকে আর তাই গেলাম না। এর মধ্যে আরেকটা চমৎকার ঘটনা ঘটলো। এদিক ওদিক ঘুরতে ঘুরতে আমি বুনো ফুলের ছবি তোলার চেষ্টা করছিলাম। হঠাৎ দেখি অমিতের হাত ধরে প্রমিতি একটা ছোট্ট সেতু পার হচ্ছে। ওদের সামনে, দু’পাশে কুয়াশার মতো মেঘ। পেছন থেকে ওদের দেখে হঠাৎ মনে হলো বাবার হাত ধরে পরম নির্ভরতায় কন্যা হেঁটে চলেছে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের পথে। দারুণ একটা দৃশ্য। আমার হাতের মোবাইল ক্যামেরা ক্লিক করে উঠলো।

ইকো পার্ক ভ্রমণ সত্যিই একটা দারুণ অভিজ্ঞতা ছিল। আমরা ভাগ্যবান যে কয়েক মিনিটের জন্য হলেও গভীর খাদ আর পাহাড়ি ঢালের সৌন্দর্য দেখতে পেয়েছি। অল্প কিছুক্ষণ পর যারা সেখানে গিয়েছেন মেঘে ঢেকে যাওয়ায় তারা এসব কিছুই দেখতে পাননি। অবশ্য মেঘালয়ে এটা খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। রূপকথার মতো সুন্দর তার সৌন্দর্য ভোগ করতে চাইলে ভাগ্যও সহায়ক হওয়া লাগে। আর সেটা হারে হারে টের পেলাম চেরাপুঞ্জির সেভেন সিস্টার ফলস দেখতে গিয়ে।

সেভেন সিস্টার ফলস দেখার জন্য নির্দিষ্ট জায়গায় যখন পৌঁছালাম তখন বিকেল নেমেছে। এখানেও পাহাড়ের কিনারায় রেলিং বাঁধা। সেখানে দাঁড়ালে এক পাশের পাহাড় জুড়ে দেখা যাবে সাত বোন আর তাদের সঙ্গী ঝরনাদের। আর অন্য পাশে দেখা যাবে বাংলাদেশকে। এলাকাটিতে পর্যটকদের ভিড়। মেঘালয়ে আসার পর যাদের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে তাদের অনেকেই মেঘের কারণে সেভেন সিস্টার ফলস দেখতে পাননি।

আমরাও যখন গাড়ি থেকে নামলাম, দেখলাম রেলিংয়ের ওপার ঘন মেঘে ঢাকা। কিছুই দেখা যাচ্ছে না। তারপরও আমরা রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে রইলাম। এক মিনিট, দুই মিনিট করে কিছু সময় গড়িয়ে গেলো। তারপর সত্যি সত্যি মেঘেরা আস্তে আস্তে সরতে শুরু করলো। আর সাত বোন তাদের সহচরীদের নিয়ে আমাদের নজরের সামনে আসতে শুরু করলো। কী সুন্দর, কী সুন্দর! এ যে কল্পনাকেও হার মানায়। এরা যে কুহকিনী। যে একবার তাকিয়েছে সেই রূপের আগুনে জ্বলে পুড়ে মরেছে। মেঘ যত সরছে সবাই আনন্দে চিৎকার করছে। কোন অ্যাঙ্গেল থেকে সুন্দরীদের ভালো করে দেখা যাবে তা দখল করার চেষ্টা করছে। আমরা যতক্ষণ সেখানে ছিলাম পুরোটা সময় মেঘ যেন আমাদের সঙ্গে খেলা করলো। আমি সেভেন সিস্টার ফলসের মেঘের আড়ালে হারিয়ে যাওয়া আবার বের হয়ে আসার খেলাটা দারুণ উপভোগ করলাম। এক সময় অন্যপাশে বাংলাদেশের স্থলভাগও পরিষ্কার ফুটে উঠলো। এর আগ পর্যন্ত এটিও মেঘের আড়ালে ছিল। অনেকেই মোবাইলে নেটওয়ার্ক পাওয়া যায় নাকি সেই চেষ্টা করতে শুরু করলেন।

আমাদের খিদে লেগে গিয়েছিল। হালকা কিছু খেয়ে প্রমিতিকে অমিতের জিম্মায় রেখে আমি এক কাপ চা হাতে একটা বেঞ্চে বসলাম। বিকেলের নিবে আসা আলোয় আমি আর সাত বোন তখন মুখোমুখি। আহ! কি অসাধারণ সেই মুহূর্ত। মেঘালয়ের প্রতিটি পাথর, মাটি, পানির কণা সবই হয়ত রূপের খনি, কিন্তু সেভেন সিস্টার ফলসের একটা জাদুকরী সৌন্দর্য আছে তার সঙ্গে কোনো কিছুরই তুলনা হয় না। তাদের দিকে তাকিয়ে মন আকুল হয়ে ওঠে। অজানা ব্যথায় হৃদয় কেঁদে কেঁদে বলে: ‘জানি চরম সত্যের কাছে নত হতে হয় সবাইকে – জীবন সুন্দর আকাশ-বাতাস পাহাড়-সমুদ্র সবুজ বনানী ঘেরা প্রকৃতি সুন্দর আর সবচেয়ে সুন্দর এই বেঁচে থাকা তবুও কি আজীবন বেঁচে থাকা যায়।’

– দৈনিক পঞ্চগড় নিউজ ডেস্ক –