• বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ১২ ১৪৩১

  • || ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫

সর্বশেষ:
যুদ্ধের অর্থ জলবায়ু পরিবর্তনে ব্যয় হলে বিশ্ব রক্ষা পেত- প্রধানমন্ত্রী দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদনের রেকর্ড মেডিকেল কলেজের ক্লাস অনলাইনে নেয়ার নির্দেশ স্বাস্থ্যমন্ত্রীর ‘গণতান্ত্রিক রীতিনীতি না মানলে জনগণই বিএনপিকে প্রতিহত করবে’ লালমনিরহাটে হত্যা মামলায় বিএনপির দুই নেতা কারাগারে

রাঙামাটির অদেখা ‘সৌন্দর্য’!

প্রকাশিত: ৯ ডিসেম্বর ২০১৮  

কাপ্তাই লেকের ট্রলারে বসে ভাবলাম, ইশ! যদি পাখি হতাম পুরো লেক একচোখে দেখে নিতাম। নীল জলরাশির কাপ্তাই লেক, স্বচ্ছ নীলাভ জল আর বিস্তৃত দেখে এমনটা ভাবা স্বাভাবিক।

সবুজ বৃক্ষ আচ্ছাদিত উঁচু-নিচু পাহাড়। গভীর মমতা আর ভালোবাসায় গড়া উপজাতীয়দের বর্ণিল জীবনধারা, অপূর্ব সুন্দর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মিলিত আহ্বান। এমন সব সৌন্দর্য এক জায়গায় মিলিত হয়েছে দেশের যে স্থানটিতে তার নাম কাপ্তাই। প্রকৃতির প্রায় সব রূপ-রং যেন এখানে এসে মিশেছে একই সমান্তরালে।

 

1.রাঙামাটির অদেখা ‘সৌন্দর্য’!

আমাদের দেশের বিশাল জায়গা জুড়ে এই কাপ্তাই লেক। এর আগেও বেশ কয়েকবার রাঙামাটি যাওয়া হয়েছে তাতে কাপ্তাই লেকের কিছুই দেখা হয়নি! শুভলং ঝরনা কিংবা ঝুলন্ত ব্রিজ পর্যন্তই ছিলো সে দৌড়ে। কয়েকদিন আগে ফেসবুকে থেগামুখ ট্রিপ দেখার পর গুগল ম্যাপ ঘেটে ইচ্ছা হলো কাপ্তাই লেকের রুটগুলোতে ঘুরবো যতটকু পারি। তিন দিনের এই ট্রিপে সবগুলো রুট কাভার করতে পারিনি। তবে ঘুরেছি অনেকখানি! রাঙামাটি-শুভলং বাজার-কাট্টলীবাজার-বারোবুনিয়া-লংগদু-মাইনীমুখ-শুভলং বাজার-বরকল-কলাবুনিয়া-মাইপলেন-এরাবুনিয়া-ভূষণছড়া-ছোটহরিনা-রাঙামাটি এই ছিলো এবারের যাত্রাপথ!

ঢাকা থেকে রওনা দিই ১৮ নভেম্বর। রাঙামাটির বাস যখন রিজার্ভ বাজার পৌঁছায় তখন ভোর। পুরো রাঙামাটি কুয়াশায় আচ্ছন্ন ছিলো। লংগদুর প্রথম লঞ্চ ছাড়ে ৭টা ৩০মিনিটে। ঘাটে গিয়ে জানতে পারলাম আজ শুভলং হাটবার, তাই সরাসরি লংগদু না গিয়ে উঠে গেলাম জুরাছড়ির লঞ্চে। সব লঞ্চ শুভলং বাজার হয়ে যায় তাই যেকোনো একটা লঞ্চে উঠলেই শুভলং বাজারে নামতে পারবেন।

 

2.রাঙামাটির অদেখা ‘সৌন্দর্য’!

শুভলং বাজারের পাশে রঙরাঙ পাহাড়। রূপের রানী রঙরাঙ, প্রকৃতির দৃঢ়তা আর রূঢ়তার মাঝেও যে অপার সৌন্দর্য লুকিয়ে আছে, এ যেন তারই সাক্ষ্য দিয়ে চলেছে অবিরাম। প্রকৃতির দু’হাত ভরে উজাড় করে দেয়া সেই রূপ নিজের চোখে না দেখলে হয়তো বিশ্বাস হবার নয়। রাঙ্গামাটির কাপ্তাই লেকের বালুখালীতে ঘোরাঘুরি করার কোনো এক ফাঁকে দেখা করতে পারেন রঙরাঙের সঙ্গে। অদূরের সেই পাহাড়ের ওপর চোখ পড়তেই বদলে যাবে মনের সব অনুভূতি, ক্লান্তি-জরার কালো মেঘ সরে গিয়ে ভেসে উঠবে রংধনুর সাত রঙ। এ পাহাড়ের আদিবাসীদের কাছ থেকে জানা যায়, রঙরাঙ পাখির নামানুসারে নাকি এ পাহাড়ের নাম হয়েছে রঙরাঙ। এ রঙরাঙ পাখি অনেকটা ধনেশ পাখির মতো দেখতে। একটা সময় ছিল, যখন এখানকার সুবলং এলাকায় কর্ণফুলী নদীর পাড়ে এবং আশপাশের পাহাড়ে রঙরাঙ পাখির আনাগোনা ছিল বেশ।

ক্যাম্পঘাট থেকেই সিঁড়ি উঠে গেছে, হেঁটেই চূড়ায় চলে যাওয়া যায়। চূড়ায় উঠে পিছনের দিকে যেয়ে কিছুটা অবাক হলাম! বহুকাল ধরে এই জায়গার একটা ছবি নেটে ঘুরেফিরে সামনে আসত কিন্তু কোনো তথ্য পাইনি! এই পাহাড়ের চূড়া থেকে দেখা কাপ্তাই লেকের দৃশ্য অসাধারন। দুইপাশে খাড়া পাহাড় মাঝে উপর থেকে দেখা নৌকাগুলো পিপড়ার মত দেখায়। পানির রঙটাও একদম ঝকঝকে। উপর থেকে সমস্ত শুভলং বাজার আর তার সামনে বিশাল কাপ্তাই লেক সুন্দরতম কিছু দৃশ্যের তালিকায় থাকবে।

 

3.রাঙামাটির অদেখা ‘সৌন্দর্য’!

পাহাড় থেকে নেমে শুভলং বাজার ঘুরে দেখতে অনেক সময় চলে যায়। সাড়ে ১১ টার দিকে মারিশ্যাগামী, পরের লঞ্চে উঠে গেলাম কাট্টলী বাজারের উদ্দেশ্যে।

লেকের মাঝে ছোট্ট এক দ্বীপ কাট্টলী বাজার। চারদিকে পানি আর পানি, দূরে বিশাল কিছু পাহাড়। বাজারে ঢুকতেই নাকে আসবে শুঁটকির গন্ধ। অন্যপাশে একটা মসজিদ আর ট্রলারের ঘাট সাথে বেশ কিছু দোকানঘর। দ্বীপের মানুষের মুখে আফসোস, কাট্টলীর আগের সেই জৌলুস নাকি নাই। জুম্মার নামাজ পড়ে খেয়ে-দেয়ে আড়াইটার দিকে মাইনীমুখগামী লঞ্চে উঠে পড়ি। লংগদু পৌঁছাতে বিকাল ৫টা বেজে যায়। সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত লঞ্চেই কেটেছে। চা-বিস্কুট, কেক আর কলা খেয়েই পার করেছি এতটা সময়।

 

4.রাঙামাটির অদেখা ‘সৌন্দর্য’!

রিজার্ভ বাজার থেকে লংগদু আসতে একেক জায়াগার দৃশ্য একেক রকম। কখনো পাহাড়ের কোল ঘেষে আবার কখনো পাহাড়গুলোকে অনেক দূরে ফেলে। লংগদু পৌঁছে থাকার বোর্ডিং না পাওয়ায় চলে গেলাম মাইনীমুখ বাজার। নতুন আঁকাবাঁকা পাহাড়ি রাস্তাটা শেষ বিকেলে প্রাণ জুড়িয়ে দেয়। আলোয় আলোকিত কাপ্তাই লেকের বুকে দাঁড়ানো মাইনীমুখ আর্মি ক্যাম্পের নতুন পার্ক। এতো আলোর মাঝেও অন্ধকার কাপ্তাই লেকের মাঝে ছোট ছোট ডিঙি নৌকার হ্যাজাক লাইটগুলোই বেশি টানে।

পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে পাহাড়িকা বোর্ডিং-এর খোলা ছাদে বের হতেই চোখে পড়লো মেঘ কুয়াশায় ঢাকা কাপ্তাই লেক। হালকা নাশতা করে উঠে পড়লাম সকাল সাড়ে ৭টার বিরতিহীন লঞ্চে, পথে থামবে শুধু লংগদু আর শুভলং ক্যাম্পঘাটে। তবে লঞ্চে উঠার আরো অনেক উপায় আছে, অনেকেই নৌকা নিয়ে লেকের মাঝখানে লঞ্চের আশায় বসে থাকে, লঞ্চ একটু স্লো করলেই উঠে যায়। আবার অনেকে লেকের মাঝে নেমেও গেলো। কিছুটা এয়ারপোর্ট থেকে ব্যাক্তিগত গাড়ি নিয়ে বাড়ি ফেরার মতো। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে লঞ্চ এগিয়ে চলে শুভলং বাজারের দিকে।

 

5.রাঙামাটির অদেখা ‘সৌন্দর্য’!

কিছুক্ষণের মধ্যে নেমেও গেলাম শুভলং বাজার। আমাদের রেখে লঞ্চ চলে গেলো রাঙামাটি, আর আমার উদ্দেশ্য বর্ডারের কাছের বাজার ছোট হরিনাতে। ঝকঝকে আকাশ কাঠের লঞ্চের ছাদে চামড়া পোড়ানো রোদ, যেতে মন চায় না শুভলং বাজার ছেড়ে। লঞ্চ এগিয়ে চলে বরকলের দিকে। দুইদিকে পাহাড়ের উচ্চতা বাড়তে থাকে আর জানান দিতে থাকে বরকল খুব বেশি দূরে নয়। ২০ মিনিটের যাত্রা বিরতিতে বরকল বাজারে দুপুরের খাবার সেরে নিই। বরকলের চারপাশটা আমার কাছে অনেক ভালো লেগেছে। শুধু বরকল দেখার জন্যই এখানে আসা যায়!

বরকল বাজার ছেড়ে আঁকাবাঁকা কর্নফুলীর উপরের দিকে চলছে আমাদের লঞ্চ। পাহাড়ের কোলে ছবির চেয়েও সুন্দর গাছে ঢাকা ছোট ছোট ঘরবাড়ি। তবে ততোটা সুন্দর না তাদের জীবনযাত্রা। কলাবুনিয়া, মাইপলেন, এরাবুনিয়া, ভূষনছড়া বাজারে মালপত্র নামাতে নামাতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে যায় ছোট হরিনা বাজারে পৌঁছতে। সেখানে নেমে আর্মি ক্যাম্পে এন্ট্রি করার সময় তাদের বেশ অবাকই মনে হলো যে এখানে ঘুরতে এসেছি কিংবা আমাদের উত্তর সন্তোষজনক ছিল না। কিছুটা তিক্ত অভিজ্ঞতা কিছুটা মিষ্টি ছোট হরিনা মনে থাকবে মানুষের মুখে এর অজানা রহস্যের গল্পের কারনে। অথবা রাতের বেলার কর্নফুলীতে নেমে ডুবে থাকার কারনে।

 

6.রাঙামাটির অদেখা ‘সৌন্দর্য’!

সন্ধ্যা হতেই দোকান-পাট প্রায় বন্ধ, তাই ৭ টার মধ্যে রাতের খাবার খাওয়া সেরে নিই। খাওয়া শেষে আর্মি ক্যাম্পের ঘাটে বসে টিভি দেখা আর কর্নফুলীর উজানে নৌকার আলো দেখেই সময় কাটানো। আর সামনে গেলে পাবেন বড় হরিনা বাজার তারও সামনে গেলে থেগামুখ। যেখানে কর্নফুলী নদী বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। ছোট হরিনার পর সামনে যেতে লাগবে লিখিত অনুমতি, সেটা মিলবে তবেই যদি থাকে অনেক ভালো রেফারেন্স।

২০ তারিখ সকাল ৬ টায় লঞ্চ ছেড়ে যায় ছোট হরিনার ঘাট থেকে, কুয়াশা মেঘ মিলে কিছুই দেখা যায় না, সাথে ঠান্ডা বাতাস। বরকল চলে আসলেও সেই মেঘ আমাদের সাথেই ছিল, বরকল থেকেই আমাদের বিদায় জানায় সে।

– দৈনিক পঞ্চগড় নিউজ ডেস্ক –