• রোববার ১৯ মে ২০২৪ ||

  • জ্যৈষ্ঠ ৫ ১৪৩১

  • || ১০ জ্বিলকদ ১৪৪৫

খামারের খরচ কমিয়ে বাড়াবে উৎপাদন উন্নতজাতের ঘাসের ব্যবহার         

প্রকাশিত: ২৮ অক্টোবর ২০২২  

খামারের খরচ কমিয়ে বাড়াবে উৎপাদন উন্নতজাতের ঘাসের ব্যবহার               
গবাদিপশু পালনে বহুবর্ষজীবী সবুজ ঘাসের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। আগের দিনে বিশাল আয়তনের প্রাকৃতিক চারণভূমি সে প্রয়োজনীয়তা মেটালেও কাঙ্খিত অর্জন হতো না। এ কারণে বর্তমান সময়ে আধুনিক প্রযুক্তিসম্পন্ন খামারে ঝুঁকছেন খারারিরা। সেজন্য গবাদি পশুপালন করতে ঘাস চাষ করার অত্যাবশ্যকতা দেখা দিয়েছে। দেশের প্রায় সব উপজেলায় সরকারিভাবে নেওয়া হয়েছে ঘাস চাষের উদ্যোগ। বিনামূল্যে দেওয়া হচ্ছে খামারীদের উন্নত জাতের কাটিং, সংরক্ষণ ও বাণিজ্যিক চাষাবাদের প্রযুক্তি। উন্নত ঘাসের কারণে এক দশকে মাংস ও দুধের উৎপাদন বেড়েছে চারগুণেরও বেশি।

বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএলআরআই) তথ্য অনুযায়ী, ঘাসের কয়েকটি জাতের ওপর নিবিড় গবেষণার পর নেপিয়ার ঘাসের উচ্চফলনশীল জাত উন্নয়ন করা হয়। জাতগুলো হলো- বিএলআরআই নেপিয়ার-১ (যা নেপিয়ার বাজরা নামে পরিচিতি), বিএলআরআই নেপিয়ার-২ (নেপিয়ার এরোসা) এবং বিএলআরআই নেপিয়ার-৩ (হাইব্রিড নেপিয়ার)।সম্প্রতি আরো একটি উচ্চফলনশীন নেপিয়ার ঘাসের জাত উদ্ভাবিত হয়েছে, যা বিএলআরআই নেপিয়ার-৪ নামে কৃষকদের মাঝে বিতরণ করা হয়েছে।

উচ্চ ফলনশীল এসব ঘাস দ্রুত বর্ধনশীল ও উচ্চ উৎপাদনশীল। এক ক্ষেত থেকে বছরে প্রায় ৪ থেকে ৮ বার ঘাস কাটা যায়। সারা বছরই এ ঘাসের উৎপাদন সম্ভব।আলাদাভাবে কাটিং বা চারার দরকার হয় না।

বিএলআরআই’র গবেষণায় দেখা গেছে, একটি ১০০ কিলোগ্রাম ওজনের গরুর জন্য প্রতিদিন ৮ থেকে ১২ কিলোগ্রাম সবুজ ঘাসের প্রয়োজন। এ ঘাস খাওয়ালে একটি গরুর দৈনিক গড়ে ২৯৬.০ গ্রাম ওজন বাড়ে। একটি দেশি গাভিতেও দৈনিক ৩.৫০ থেকে ৪.০০ লিটার দুধ উৎপাদন সম্ভব হয়।

এ বিষয়ে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী শ. ম. রেজাউল করিম বলেছেন, বর্তমান সরকারের যুগোপযোগী পদক্ষেপে দেশে প্রাণিসম্পদের উৎপাদনে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে। বাংলাদেশ এখন মাংস ও ডিমে স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং দুধে স্বয়ংসম্পূর্ণতার দ্বারপ্রান্তে। দুধ উৎপাদন বাড়াতে সরকার নানা উদ্যোগ নিয়েছে। প্রাণিসম্পদের উৎপাদন বাড়াতে প্রাণিখাদ্য ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বৈশ্বিক সংকটময় পরিস্থিতিতে আমদানিনির্ভর দানাদার খাদ্যের দাম কিছুটা বেড়ে যাওয়ায় বিকল্প হিসেবে উন্নত জাতের ঘাস চাষে সরকার গুরুত্ব দিচ্ছে। প্রাণিপুষ্টির উন্নয়নে উন্নত জাতের ঘাসের চাষ সম্প্রসারণে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। এর মাধ্যমে বিজ্ঞানভিত্তিক ও আধুনিক পদ্ধতিতে কাঁচা ঘাস সংরক্ষণের জন্য লাগসই প্রযুক্তিও খামারিদের মাঝে হস্তান্তর করা হচ্ছে। এ প্রকল্পের আওতায় উন্নত জাতের ঘাস চাষ ও সংরক্ষণে খামারিদের প্রশিক্ষণও দেওয়া হচ্ছে।

উন্নত ও বহুবর্ষজীবী নেপিয়ার জাতের ঘাস অব্যবহৃত, অনাবাদি ও পতিত জমিতে চাষের জন্য খামারিদের উৎসাহিত করা এবং প্রশিক্ষণসহ নানা ধরনের প্রণোদনা দেয়া হচ্ছে।যেসব খামারি উন্নত জাতের কাঁচা ঘাস ব্যবহার করছেন, তাদের উৎপাদন খরচ অনেক কম পড়ছে। এতে উৎপাদিত পণ্যের মানও ভালো হচ্ছে এবং গবাদিপশুর স্বাস্থ্যও ভালো থাকছে, জানান তিনি।

প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন প্রকল্পের (এলডিডিপি) চিফ টেকনিক্যাল কো-অর্ডিনেটর ড. মো. গোলাম রব্বানী  বলেন, দেশের ৬১ জেলার ৪৬৬ উপজেলা প্রাণিসম্পদ অফিস গ্রাউন্ডে উন্নত জাত ও বহুবর্ষজীবী ঘাসের নার্সারি করা হয়েছে। এসব নার্সারি থেকে খামারিদের বিনামূল্যে ঘাসের কাটিং সরবরাহ করা হচ্ছে। প্রকল্প থেকে ঘাস চাষের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে ও বাণিজ্যিক ঘাস চাষে সহায়তা দেয়ার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। বাণিজ্যিকভাবে খাদ্য উৎপাদনে আগ্রহীদের স্মল ম্যাচিং গ্র্যান্টের (আংশিক টাকা) আওতায় সহায়তা দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সংরক্ষণের অভাবে যেন উৎপাদিত ঘাস নষ্ট না হয়, সেজন্য সংরক্ষণ বা প্রক্রিয়াজাতকরণ পদ্ধতি পাইলটিং করা হবে। এখনও আমাদের দেশের খামারি হাউস হোল্ড ইন্ট্রিগেটেড, একারণে খাদ্য তৈরি বা সংরক্ষণে উদ্যোক্তা তৈরি করা হবে।

গবেষণার তথ্য উল্লেখ করে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (প্রাণিপুষ্টি বিভাগের) অধ্যাপক এবং এলডিডিপি প্রকল্পের রুমিনেন্ট নিউট্রেশন এক্সপার্ট ড. মোহাম্মদ আল মামুন বলেন, ধান চাষে আমাদের যে আয় হয় তার দেড়গুণ বেশি লাভ হয় বহুবর্ষজীবী ঘাস চাষে। ৪ থেকে ৫ বছরের হিসেবে এ লাভ হয় আরো বেশি।

তিনি বলেন, গবাদি পশু মোটাতাজাকরণের ক্ষেত্রে গ্রোথ প্রোমোটার বা অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার সরকারি নানা উদ্যোগের ফলে কমে আসলেও নির্মুল করা সম্ভব হয়নি। প্রাণি খাদ্যে ‘প্লানটেইন ঘাস’ ব্যবহার করে অ্যান্টিবায়োটিকের এই ক্ষতিকর প্রভাবের হাত থেকে গবাদিপশু রক্ষা, মাংস ও দুধ উৎপাদন বৃদ্ধিতে সফলতা পাওয়া সম্ভব।

নিজস্ব গবেষণার তথ্য উল্লেখ করে ড. আল মামুন বলেন, ঔষধি উদ্ভিদ অ্যান্টিবায়োটিকের বিকল্প পশুখাদ্য হতে পারে। এরকমই একটি ঘাস-জাতীয় ঔষধি উদ্ভিদ হলো প্লানটেইন। যা কোনো ধরনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ছাড়াই পশুর শরীরে অ্যান্টিবায়োটিক গ্রোথ প্রোমোটার কিংবা তার চেয়ে বেশি কাজ করবে।

তার মতে, গরু বা ভেড়াজাতীয় পশুকে স্বাভাবিক খাবারের সঙ্গে খুব সামান্য পরিমাণে (পোল্ট্রিতে ১শতাংশ, ভেড়ায় ৪শতাংশ, গরুতে ৫-১০শতাংশ) প্লানটেইন ঘাস ও এর পাউডার মিশিয়ে খাওয়ালে প্রাণীর উচ্চ তাপমাত্রার পীড়ন (হিট স্ট্রেস) কমিয়ে প্রোটিন সংশ্লেষণ বাড়ায়। এটি হরমোনের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে দুগ্ধবতী ও গর্ভবতী প্রাণীর দুধের উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ায় এবং সুস্থ-সবল বাচ্চা জন্ম দিতে সহায়তা করে।

তিনি আরো বলেন, উন্নত জাতের ঘাস ব্যবহারে আমাদের দেশের খামারিরা খুব একটা সচেতন নয়। প্রযুক্তি ব্যবহারে রাজি করানোও সহজ নয়। এজন্য কিছুটা সময় নিতে হবে। আমাদের দেশে অনেক খামারী ফিড মিল চালু করেছেন। তারা ইচ্ছে করলেই খাবারের সঙ্গে ওষুধি ঘাস ব্যবহার করতে পারেন। এক একর জমিতে উৎপাদিত প্রায় ১০ মে. টন ঘাস প্রায় ৪ লাখ মুরগির খাবারে ব্যবহার করা যায়। পশু খাবারে তেলাকচু পাতা, মোরিঙ্গা বা সজিনা পাতাও ব্যবহার করা যেতে পারে।

বাংলাদেশ ডেইরি ফার্মার্স এসোসিয়েশনের সভাপতি এবং সাদেক অ্যাগ্রো ফার্ম-এর স্বত্তাধিকারী মো. ইমরান হোসেন বলেন, খামারের উন্নয়ন তথা পণ্যের মাণ ও উৎপাদন কাঙ্খিত পর্যায়ে নিতে হলে খামারের পশুখাদ্য ব্যবস্থাপনা গুরুত্বপূর্ণ। পশুখাদ্যের দাম অনেক বৃদ্ধি পাওয়ায় খামারগুলো টিকিয়ে রাখতে অনেক কষ্ট করতে হচ্ছে। তার খামারে প্রায় ১৫শ’র বেশি গরু রয়েছে। এরমধ্যে দুধের গরু রয়েছে ৩১২টি এবং মাংসের গরু রয়েছে ১২০০টি। এসব গরুর জন্য প্রতিদিন প্রায় ১০ হাজার কেজি কাঁচাঘাস প্রয়োজন। এ প্রয়োজন মেটাতে সাভার ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় ১৫০ বিঘা জমিতে নেপিয়ার, রেড নেপিয়ার, জারা এবং আলফা আলফা ঘাস চাষ করছেন। এছাড়া মানিকগঞ্জ এবং ধামরাই এলাকার কিছু চাষীকে দিয়ে চুক্তিতে ভুট্টা চাষ করাচ্ছেন।

তার দাবি, উন্নত এবং বহুবর্ষজীবী ঘাস চাষ করতে খামারিদের সরকারের পক্ষে থেকে খাসজমি, বেড়িবাঁধ এবং অব্যবহৃত জমি লিজ বা বরাদ্দ দেয়া প্রয়োজন। তাহলে তারা খামার টিকিয়ে রাখতে পারবে।

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, চাহিদার তুলনায় উন্নত জাতের ঘাস অপ্রতুল। দেশে বর্তমানে ঘাস চাষযোগ্য জমির পরিমাণ ১৪.৮২ লাখ একর হলেও উন্নত জাতের বহুবর্ষজীবী ঘাসের চাষ হচ্ছে মাত্র ৩২ হাজার হেক্টর জমিতে, যা প্রতি বছর গড়ে ১০ বা ২০ শতাংশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০২১-২২ সালে দেশে গবাদিপশু ছিল ৫ কোটি ৬৭ লাখ ৩৪ হাজার। এরমধ্যে গরু ও মহিষ ছিল ২ কোটি ৬২ লাখ ৮০ হাজার, বাকিটা ছাগল ও ভেড়া। এ হিসেবে দেশে প্রতিদিন উন্নত জাতের কাঁচাঘাস প্রয়োজন প্রায় ১৬ কোটি মেট্রিক টন (গরু-মহিষ ১২ কেজি, ছাগল-ভোড়া ৪ কেজি হিসেবে)। অন্যদিকে এত বিপুল সংখ্যক চাহিদার পেছনে যোগান দেয়া যাচ্ছে মাত্র ৬.৪০ কোটি মে. টন। ঘাটতি থাকছে ৯.৬০ কোটি মে. টন।

দেশের ৪৭৫ উপজেলায় বহুবর্ষজীবী ঘাষ চাষ কার্যক্রম সম্প্রসারণের কাজ চলছে। গত চার মাসে নতুন করে ২০৬ একর জমি উন্নতজাতের ঘাসের চাষে যুক্ত হয়েছে। স্থায়ীভাবে ঘাস চাষে যুক্ত রয়েছে ৭৮০৫ একর জমি। প্রতি একর জমিতে নেপিয়ার পাকচং চাষ করে প্রায় ২০০ মেট্রিক টন ঘাস সংগ্রহ করা সম্ভব।

সরেজমিন সিরাজগঞ্জ, সাতক্ষীরা, যশোর এবং খুলনার বিভিন্ন ইউনিয়নের খামারে গিয়ে দেখা গেছে, দানাদার খাবারের কারণে অনেক খামারি এখন উন্নতজাতের বহুবর্ষজীবী পাকচং ও নেপিয়ার, কালার নেপিয়ার ঘাস চাষ করছেন। তবে সিরাজগঞ্জের অধিকাংশ জায়গা প্রায় চার মাস বৃষ্টির পানিতে ডুবে থাকে। এতে খাবারের সংকট দেখা দেয়।পানি শুকাতেই রোপন করা হচ্ছে উন্নতজাতের ঘাস। অনেকে নিজের খামারে ঘাসের চাহিদা মিটিয়ে বিক্রিও করছেন। অনেকে বাণিজ্যিকভাবেও পাকচং ঘাস চাষ শুরু করেছেন।

সাতক্ষীরা সদর উপজেলার এলডিডিপি প্রোডিউসার গ্রুপের (পিজি) সদস্য সাজ্জাদ আলী গাজী বলেন, এই এলাকায় অনেক দুধ উৎপাদন হলেও প্রকৃত দাম না পেয়ে অনেক খামারি খামার বন্ধ করে দিচ্ছেন। অনেকে কোরবানীর ঈদে সব গরু বিক্রি করে দিয়েছেন। বর্তমানে তার খামারে ১৫টি গরু রয়েছে। প্রতিদিন ৯০-১০০ কেজি দুধ পেলেও দাম পাওয়া যায়না। বাজারে দুধের দাম অনেক চড়া হলেও তাদের প্রতিকেজি দুধ বিক্রি করতে হয় মাত্র ৪০-৪২ টাকায়।

তিনি আরো বলেন, দানাদার খাবারের দাম বাড়ার কারণে খামারের খরচ অনেক বেড়েছে। গত কয়েক বছর ধরে তিনি খামারে দানাদার খাবারের পরিমাণ কিছুটা কমিয়েছেন। পশুখাদ্যে বাড়িয়েছেন কাঁচা ঘাসের পরিমাণ। তিনি বর্তমানে সাত বিঘা জমিতে বহুবর্ষী নেপিয়ার জাতের ঘাস লাগিয়েছেন। কাঁচা ঘাস ব্যবহারের ফলে তার খামারে দুধের উৎপাদন প্রতি গরুতে এক থেকে দুই কেজি বেশি হচ্ছে। গরুগুলো প্রতি বছর ঠিক সময়ে বাচ্চাও দিচ্ছে।

পিজি সভাপতি সৌরভ মল্লিক বলেন, দেশের দ্বিতীয় দুধ উৎপাদনকারী জেলা সাতক্ষীরা। উপকূলীয় এলাকা হলেও প্রায় প্রতি ঘরে দুধের গরু রয়েছে। কিন্তু দানাদার খাদ্যের দাম বাড়ায় নাভীশ্বাস উঠছে খামারীদের। পশুখাদ্যের দাম বাড়ায় খামারিদের ক্ষতি হচ্ছে। সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দুধ ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলোর দৌরাত্ব। তারা নিজেদের মতো করে দুধের দাম নির্ধারণ করে। খামারিরা এর বাইরে যেতে পারছে না। দানাদার ও বিচালি খাওয়ানোর কারণে খরচ বেশি হচ্ছে। এ কারণে তিনি পশুখাদ্যের যোগান দিতে ৫ বিঘা জমিতে নেপিয়ার পাকচং জাতের বহুবর্ষজীবী ঘাসের চাষ করছেন। তার দৈনিক চাহিদার ৪শ’ কেজি ঘাস এখান থেকেই যোগান দেয়া হচ্ছে। প্রতি বছর প্রায় ৪-৮ বার ঘাস কাটতে পারেন। এতে তার গরুর চেহারা ভালো হচ্ছে, দুধও বেশি হচ্ছে এবং গাভিগুলো প্রতি বছরই বাচ্চা দিচ্ছে। বাচ্চার স্বাস্থ্য ও ভালো হচ্ছে।

প্রাণিসম্পদ দপ্তরের খুলনা বিভাগীয় পরিচালক ডা. সুখেন্দু শেখর গায়েন বলেন, লবনাক্ততার জন্য দেশের উপকুলীয় জেলাগুলোর প্রায় ১ কোটি গবাদিপশু পশুখাদ্য সংকটে ভোগে। এ সংকট মেটাতে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করতে পারে বহুবর্ষজীবী সবুজ ঘাসের ব্যবহার। এজন্য লবন-সহিষ্ণু ঘাসের জাত উদ্ভাবন জরুরি।

তিনি বলেন, একসময়ে ১০০ কেজি ওজনের গবাদিপশুর ক্ষেত্রে সোয়া কেজি দানাদার, ২.৫ থেকে ৩ কেজি দুধের গাভীর জন্য আরো এক কেজি বেশি দানাদার খাবার দেয়া হতো। সঙ্গে থাকতো কিছু ঘাসও। কিন্তু এখন সেই হিসাব মেলে না। এখন প্রতিগরুর জন্য ৮ থেকে ১২ কেজি পাকচং বা উন্নতজাতের ঘাস নিশ্চিত করা গেলে খামারে কাঙ্খিত উৎপাদন পাওয়া সম্ভব। গর্ভধারণের জন্য ফসফরাস গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে, কিন্তু দেশি ঘাসে এর পরিমাণ কম থাকে। প্রয়োজনীয় কাঁচাঘাস নিশ্চিত করা সম্ভব হলে এড়ে বা গাভীর প্রয়োজনীয় ফসফরাসের চাহিদা পূরণ হয়।

 যশোর সদর উপজেলার ফাতেহপুর ইউনিয়নের খামারি জয়নাল আবেদিন জানান, তার খামারে ১১০টি গরু রয়েছে। করোনার পরে দ্রব্যমূল্য ও পশুখাদ্যের দাম বাড়ার কারণে খামারে দুধের উৎপাদন কমিয়ে দিয়েছেন। এখন মানুষ দুধ কম কিনছে। ফলে দাম কম পাওয়া যাচ্ছে। আমরা তো দুধ মজুদ করতে পারছি না। অনেক সময় নষ্টও হচ্ছে। খাবারের যোগান দিতে তিনি ৩০ বিঘা জমিতে চাষ করছেন দ্রুত বর্ধনশীল ঘাস নেপিয়ার পাকচং। নিজের খামারের চাহিদা পূরণ করে বাকিটা বিক্রি করেন তিনি। প্রতিদিন খামারের প্রয়োজনীয় ৩ টন ঘাস নিজের ক্ষেত থেকেই পাওয়া যায়। ঘাস খাওয়ানোর ফলে খামারে উৎপাদন বেড়েছে। অনেককে চাষের জন্য ঘাসের কাটিংও দিয়েছেন তিনি।

তিনি জানান, সরকারের উচিৎ ছোট ছোট প্রযুক্তি সহায়তা দিয়ে আমাদের উৎপাদিত পণ্য সংরক্ষণের সুযোগ তৈরি করে দেওয়া। সরকার বিসিক নগরিতে ঘাস উৎপাদন ও সহায়ক প্লান্ট স্থাপনের জন্য জমি বরাদ্দ দিতে পারে।

একই গ্রামের মো. আসাদুজ্জামান বলেন, তার খামারে ১৫টি গরু রয়েছে। তিনি এক খামারির কাছ থেকে কাটিং এনে এক বিঘা জমিতে ঘাস চাষ করছেন।

খুলনা ডুমুরিয়া উপজেলার চহেরা রোদগড়া ইউনিয়নের পরিমল দাস জানান, প্রাণিখাদ্যের মূল্য বৃদ্ধির কারণে ৫টি গরু বিক্রি করে এখন তিনি ৫টি গরু লালন করছেন। ৫ বিঘা জমিতে তিনি পাকচং ও কালার নেপিয়ার চাষ করেছেন। প্রতিদিন প্রায় ৪০ কেজি ঘাস বিক্রি করেন। প্রতি কেজি ৫ টাকা করে ২০০ টাকা আয় হয়। এ টাকা দিয়ে পশুর জন্য দানাদার খাদ্যসহ গবাদিপশুর পেছনে ব্যয় করেন।

কিন্তু নেপিযার পাকচং দুবার কাটার সময়ে কালার নেপিয়ার একবারও কাটা সম্ভব হয় না। কারণ কালার নেপিয়ারের বৃদ্ধি খুবই কম। কালার নেপিযারের পুষ্টি বেশি কিন্তু লাভ কম। এ কারণে খামারিরা পাকচং বেশি চাষ করছেন।

ডুমুরিয়া চুপনগর আটলিয়া ইউনিয়নের জাতীয় যুব পুরস্কারপ্রাপ্ত খামারি বাসুদেব দত্ত জানান, তার ‘দত্ত পোলট্রি ও ডেইরি ফার্মে’ প্রায় ৬ হাজার মুরগি রয়েছে। রয়েছে ১০টি দুধের গরু। রয়েছে সৌখিন রঙিন মাছের খামার। দানাদার খাবারের যোগান দিতে তৈরি করেছেন ছোট ফিড মিল। প্রতিদিন ২৫০ কেজি ঘাস লাগে। ৩৫ শতাংশ জমিতে উন্নত জাতের নেপিয়ার চাষ করে প্রয়োজনীয় ঘাসের যোগান দেওয়া হচ্ছে। তবে পর্যাপ্ত কাঁচা ঘাস দিলে দানাদার খাবারের দরকার হয় না।গবাদি প্রাণির স্বাস্থ্যও অনেক ভালো থাকে।

আটলিয়া ইউনিয়নের বড়াতিয়া গ্রামের অনিমেশ দে বলেন, তিনি নেপিয়ার পাকচং চাষ করছেন দেড় বিঘা জমিতে। তার প্রয়োজনের তুলনায় বেশি ঘাস উৎপাদন হয়। প্রতিকেজি ৫ টাকা দরে বিক্রি করেন তিনি। দানাদার খাবারের দাম বৃদ্ধির পর থেকেই তাদের ঘাসের চাহিদা বেড়েছে। অনেকে আবার জমি থেকেও ঘাস কেটে নিয়ে যান। কেউ কেউ আবার মাসিক ভিত্তিতেও ঘাস নিয়ে থাকে। 

গুটুদিয়া ইউনিয়নের জাহিদুল ইসলাম সিঙ্গাপুর থেকে দেশে এসে  গত ৫ বছর ধরে ঘাস ব্যবসা করছেন। বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ১৭ বিঘা জমিতে চাষ করছেন নেপিয়ার পাকচং এবং রঙিন নেপিয়ার। প্রতিদিন ৫ জন কর্মচারি ঘাস কাটা ও যত্ন নিয়ে থাকেন। বেশ কিছু খামারি চুক্তিতে তাদের কাছ থেকে ঘাস নিয়ে থাকেন। প্রতিদিন ৫ টাকা কেজি দরে ১৫শ’ কেজি ঘাস বিক্রি করেন।

তিনি জানান, সরকারি কোন পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়াই নিজের কিছু জমির পাশাপাশি লিজে জমি নিয়েও ঘাস চাষ করছেন। জমিতে ঘাসের কাটিং লাগানোর ৪৫ দিন পরে নেপিয়ার পাকচং কাটার উপযোগী হয়। লাভজনক না হওয়ায় রঙিন নেপিয়ার বেশি পুষ্টিকর হলেও অনেকে চাষ করে না।

খুলনার ডুমুরিয়ার ধানিবুনিয়া ইউনিয়নের এসএস ইন্টারন্যাশনাল এ্যাগ্রো সম্প্রতি ডেইরি আইকন পুরস্কার পেয়েছেন। প্রধান ফটক দিয়ে ঢুকতেই জীবানুমুক্তকরন চৌবাচ্চা, এর পাশেই গোচারণ ভুমি। ছাগল ভেড়ার জন্যও রয়েছে আলাদা চারণভুমি। রয়েছে বিভিন্ন ফলের বাগান, প্রতি তলা ১০ হাজার স্কয়ার ফুটের ৫তলা ভবন। নিচ তলায় ডেইরি ফার্ম ও ফিড মিল। দ্বিতীয় থেকে ৫ম তলা পর্যন্ত পালন করা হচ্ছে ১০ হাজার মুরগি (পোলট্রি ও লেয়ার)। দুই পুকুরে পালন করা হচ্ছে বাগদা চিংড়ি।

প্রতিষ্ঠানটির কর্নধার জিএম শফিকুল ইসলাম জানান, খামারে বর্তমানে ৪৫টি গাভি রয়েছে। ২০১৮ সাল থেকে খামার সংলগ্ন ৫.৩১ একর জমিতে উন্নত জাত ও দ্রুত বর্ধনশীল ঘাস নেপিয়ার-২ জাতের ঘাস চাষ করছেন। তার এসব পশুর জন্য দৈনিক ৬৭৫ কেজি ঘাস, ৩০০ কেজি খর ও দানাদার খাবার প্রয়োজন।

তিনি বলেন, কাঁচাঘাস ব্যবহারের ফলে তার খামারে উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষ করে দুধ উৎপাদন এবং গাভী নির্দিষ্ট সময়ে হিটিংয়ে আসছে। ফলে প্রায় সব গাভিই বাচ্চা দেয়ার ক্ষমতা বেড়েছে।

নেপিয়ার ঘাস: সহজ চাষ পদ্ধতি ও পুষ্টিগুণের কারণে এই ঘাসের চাষ ও ব্যবহার দেশে অনেক বেশি জনপ্রিয়। বহুবর্ষী নেপিয়ার ঘাস একবার আবাদ করলে ৪-৫ বছর একটানা ঘাস পাওয়া যায়। এই ঘাসের ফলন বেশি ও পুষ্টিগুণ ভালো থাকায় খামার পর্যায়ে ব্যপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। বছরের যেকোন সময় চাষ করা যায়। নেপিয়ারে রয়েছে ড্রাই ম্যাটার ৮-১৪ শতাংশ, ক্রুড প্রোটিন ৮-১২ শতাংশ, ফাইবার ২৪-২৮ শতাংশ ও টোটাল ডাইজেস্টেবল নিউট্রিয়েন্ট (টিডিএন) ৫৫-৫৮ শতাংশ।

লাল নেপিয়ার: লাল নেপিয়ার বর্তমান সময়ে অধিক পুষ্টিসমৃদ্ধ ঘাস হলেও বৃদ্ধি কম হওয়ায় এই ঘাস চাষে খামারিদের খুব একটা আগ্রহ নেই। এই ঘাসে ড্রাই ম্যাটার রয়েছে ১৫ শতাংশ, ক্রুড প্রোটিন ১৪ শতাংশ, এ্যাশ ১০ শতাংশ ও ক্রুড ফাইবার ৩০ শতাংশ।

জার্মান ঘাস: চাষ পদ্ধতি খুবই সহজ এবং এর পুষ্টিগুণ খুবই উন্নত। জার্মান ঘাস অনেকটা লতাজাতীয় ঘাসের মত। এই ঘাস উঁচু, নিচু, ঢালু, জলাবদ্ধ, স্যাঁতস্যাঁতে এবং ফসল হয়না এমন জমিতেও চাষ করা যায়। এটিও নেপিয়ার ঘাসের মত বহু বর্ষজীবী। একবার রোপন করলে ৮-১০ বছর ঘাস পাওয়া যায়। এই ঘাসে ড্রাই ম্যাটার রয়েছে ১৫ শতাংশ, ক্রুড প্রোটিন ১৭, এ্যাশ ১৬ ও ক্রুড ফাইবার ১৯ শতাংশ।

পাকচং: চারণভুমির পরিমাণ কমে যাওয়ায় কৃষকরা অল্প জমিতে দ্রুত বর্ধনশীল নেপিয়ার-পাকচং জাতের ঘাসের আবাদ শুরু করেছে। পাকচং ঘাস গরু, ছাগলসহ গবাদি পশুর জন্য উপকারী ও উৎকৃষ্ট খাদ্য। এ ঘাস একবার চাষ করার পর কয়েক বছর পাওয়া যায়। এর পাতা ও কান্ড দেখতে কিছুটা আখ গাছের মতো। এই ঘাসে ড্রাই ম্যাটার ১৪ শতাংশ, ক্রুড প্রোটিন ১৫ শতাংশ, এ্যাশ ১১ শতাংশ ও ক্রুড ফাইবার ৩০ শতাংশ রয়েছে।

পারা ঘাস: অনেকটা দল ঘাসের মত দেখতে এই পারা ঘাস। এ ঘাস মহিষ বা পানি ঘাস নামেও পরিচিত। অল্পদিনের মধ্যেই জমিতে বিস্তার লাভ করে। এ ঘাস পুষ্টিকর, সুস্বাদু এবং উচ্চফলনশীল।এটি জলাবদ্ধ ও লবণাক্ততা সহ্য করতে পারে এবং বন্যার পানিতেও টিকে থাকতে পারে। বাংলাদেশের প্রায় সব অঞ্চলেই এ ঘাস চাষ করা যায় এবং উঁচু স্থান অপেক্ষা নিচু জলাবদ্ধ জমিতে ভাল হয়।এই ঘাসে ড্রাই ম্যাটার ১৭ শতাংশ, ক্রুড প্রোটিন ১৩ শতাংশ, এ্যাশ ১৪ শতাংশ ও ক্রুড ফাইবার ২১ শতাংশ রয়েছে।

জাম্বু ঘাস: দেশের আরেকটি জনপ্রিয় ঘাস। পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ এই ঘাসের ফলনও তুলনামুলক ভালো। এটি মুলত সরগম ঘাস। এই ঘাস বাংলাদেশে গ্যামা, সুইট জাম্বু, জাম্বু স্টার, সুদান ঘাস, জার্মান সুদান ঘাস ইত্যাদি নামে পরিচিত। এই ঘাস সাধারণত ৫-৭ ফিট পর্যন্ত লম্বা হয় ও পাতা চওড়া প্রকৃতির। এ ঘাসে ড্রাই ম্যাটার ১৯ শতাংশ, ক্রুড প্রোটিন ১৭ শতাংশ, টোটাল এ্যাশ ৮ শতাংশ, ক্রুড ফাইভার ২৬ শতাংশ রয়েছ।

হাইড্রোপনিক ঘাস: এটি মূলত অঙ্কুরিত গম, বার্লি, যব, ভুট্টা, সূর্যমুখী বা লিগুম (আলফা আলফা, মটরশুঁটি ইত্যাদি)। বীজ থেকে গাছ গজানোর পর ছয় বা সাতদিনের মাথায় গরু-ছাগলকে খাওয়ানো হয়। অত্যন্ত উপকারী এই ঘাসও খুব পুষ্টিকর। হাইড্রোপনিক ঘাসের বয়স হয় ছয় বা সাত দিনের মধ্যে চার থেকে ছয় ইঞ্চি লম্বা হয়। হাইড্রোপনিক ঘাসের অধিকাংশই পানি। এরমধ্যে ড্রাই ম্যাটার মাত্র ১০-২০ শতাংশ, ক্রুড প্রোটিন ১৬ শতাংশ, এ্যাশ ৫ শতাংশ, ফ্যাট) ০.৫ শতাংশ ও ফাইভার ৫ শতাংশ রয়েছে।
#বার্তা২৪.কম।

– দৈনিক পঞ্চগড় নিউজ ডেস্ক –