• মঙ্গলবার ০৮ অক্টোবর ২০২৪ ||

  • আশ্বিন ২৩ ১৪৩১

  • || ০৩ রবিউস সানি ১৪৪৬

গণঅভ্যুত্থানের পর শ্রীলংকা যেভাবে বামপন্থীদের হলো

প্রকাশিত: ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪  

গণবিক্ষোভের মুখে প্রেসিডেন্ট দেশ ছেড়ে পালানোর দুই বছরের বেশি সময় পর নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট পেল শ্রীলংকা। রোববার রাত আটটার দিকে দেশটির নির্বাচন কমিশন জানায়, শনিবার অনুষ্ঠিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছেন বামপন্থী অনূঢ়া কুমারা দিশানায়েকে।অনূঢ়া কুমারা প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার মধ্য দিয়ে শ্রীলংকায় রাজাপক্ষে পরিবারের টানা দেড় দশকের বেশি সময়ের একক আধিপত্যের অবসান ঘটল। ১৯৪৮ সালে শ্রীলংকার স্বাধীনতার পর থেকে শ্রীলংকা শাসন করেছে দুটি প্রভাবশালী রাজনৈতিক দল বা তাদের জোট বা তাদেরই কোনো অংশ। এর মধ্যে একটি রাজাপক্ষে পরিবারের নেতৃত্বাধীন দল ইউনাইটেড ন্যাশনাল পার্টি (ইউএনপি)। দলটি থেকে একাধিকবার প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছেন মাহিন্দা রাজাপক্ষে। গণঅভ্যুত্থানের মুখে দেশত্যাগের আগে সর্বশেষ প্রেসিডেন্ট ছিলেন তার ছোট ভাই গোতাবায়া রাজাপক্ষে।

শ্রীলংকার গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ভেরাইটি রিসার্চের নির্বাহী পরিচালক নিশান দা মেল মনে করছেন, নির্বাচনে জয়ী অনূঢ়া কুমারা দিশানায়েকে শ্রীলংকার নতুন প্রেসিডেন্ট ঘোষণার মাধ্যমে শ্রীলংকার রাজনীতিতে দুটি শূন্যতা পূরণ হবে। ১৫ বছরের বেশি শাসনক্ষমতা ধরে রাখা রাজাপক্ষে পরিবারের ওপর আস্থা হারানোর পর দেশটির রাজনৈতিক অঙ্গনে যে শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছিল, প্রথমত তা পূরণ হবে। দ্বিতীয় আরেকটি বিষয় হলো, রাজাপক্ষে যখন আগের মধ্য-বাম রাজনৈতিক ব্লককে ডানপন্থী নীতির দিকে নিয়েছিলেন, তখন মধ্য-বাম রাজনীতিতে যে শূন্যতা তৈরি হয়েছিল, তা পূরণ হবে।

নির্বাচন কমিশনের ঘোষণা অনুযায়ী, অনূঢ়া কুমারা দিশানায়েকে ৪২ দশমিক ৩১ শতাংশ ভোট পেয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। তার নিকটতম দুই প্রতিদ্বন্দ্বী বিরোধী দল সঙ্গী জন বালাওয়াগার (এসজেবি) নেতা সাজিথ প্রেমাদাসা পেয়েছেন ৩২ দশমিক ৭৬ শতাংশ ভোট। মাত্র ১৭ শতাংশ ভোট পেয়েছেন ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট রণিল বিক্রমাসিংহে।

শ্রীলংকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জনতা বিমুক্তি পেরামুনা (জেভিপি) দলের নেতা অনূঢ়া কুমারা দেশনায়েকের বিজয় দেশটির ইতিহাসে একটি উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক পরিবর্তন। কারণ নতুন প্রেসিডেন্ট অনূঢ়া ন্যাশনাল পিপলস পাওয়ার (এনপিপি) জোটের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। এই জোটের মূলে রয়েছে মার্ক্সবাদী বামপন্থী মতাদর্শ। রয়েছে চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতাও। এর ফলে এই প্রথমবারের মতো শক্তিশালী বামপন্থী পটভূমির একজন নেতা শ্রীলংকায় প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব গ্রহণ করতে যাচ্ছেন।

শ্রীলংকায় বামপন্থীদের এই বিজয়কে একটি চমক হিসেবেই দেখা হচ্ছে। কারণ এনপিপি জোট এর আগে শ্রীলংকায় খুব বেশি প্রভাব সৃষ্টি করতে পারেনি। এমনকি তারা কখনো শ্রীলংকার পার্লামেন্টে বিরোধী দলেও ছিল না। দেশটির বিগত সংসদে ২২৫টি আসনের মধ্যে মাত্র তিনটি আসন ছিল তাদের।

ধারণা করা হচ্ছে, নতুন প্রেসিডেন্ট দেশনায়েকে শিগগিরই সংসদ ভেঙে দিয়ে সংসদ নির্বাচন ডাকবেন।

এক সময় একজন বহিরাগত হিসেবে বিবেচিত দেশনায়েকের উত্থান ২০২২ সালে। সেই সময়টিতে গুরুতর অর্থনৈতিক সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে তীব্র গণ–অসন্তোষের সৃষ্টি হয়েছিল দেশটিতে। আকাশছোঁয়া মুদ্রাস্ফীতি এবং ধীরে ধীরে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমতে থাকলে দেশজুড়ে অস্থিরতা তৈরি হয়। এই অস্থিরতা শেষ পর্যন্ত দেশটির তৎকালীন প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষকে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য করে।

বলা হচ্ছে, অর্থনৈতিক টালমাটালের সেই সময়টিতে দেশনায়েকের প্রচার শ্রীলংকার রাজনীতিতে দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর আচরণ ও কর্মকাণ্ডে হতাশ ভোটারদের অনুপ্রাণিত করেছিল। আর পরিবর্তনের অনুভূতিকে পুঁজি করে অনুরণিত হয়েছিল তার দলও।

সেই সময়টিতে রাস্তায় নেমে আসা শ্রীলংকার লাখ লাখ নাগরিকের কাছে দেশে রাজনৈতিক পরিবর্তন এবং ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীকে বিতাড়িত করা ছাড়া আর কোনো উদ্দেশ্য ছিল না। সাধারণ মানুষের এই মনোভাবকে কাজে লাগিয়ে নতুন বিকল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন দেশনায়েকে ও তার দল।

সংবাদমাধ্যম বিবিসি বলছে, স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে শ্রীলংকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অনুরা কুমারা দিশানায়েকের এই জয়কে রাজনৈতিক ভূমিকম্প বলা যেতে পারে। দেশটির এবারের নির্বাচনে বামপন্থী রাজনীতিবিদদের শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে হাজির করেছে; যে কারণে তার জয় শ্রীলংকানদের জন্য অবাক করার মতো বড় কিছু নয়।

৫৫ বছর বয়সী দিশানায়েকে ন্যাশনাল পিপলস পাওয়ার (এনপিপি) জোটের প্রধান। এই জোটে রয়েছে তার নিজ দল জনতা বিমুক্তি পেরামুনা (জেভিপি) বা পিপলস লিবারেশন ফ্রন্ট। এই দলটি শক্তিশালী রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ ও নিম্ন কর নীতির প্রতি সমর্থনের পাশাপাশি বামপন্থী অর্থনীতির পক্ষে প্রচার চালিয়ে আসছে।

দিশানায়েকের জয়ের মধ্য দিয়ে এই দ্বীপরাষ্ট্র প্রথমবারের মতো শক্তিশালী বামপন্থী মতাদর্শের এক নেতার নেতৃত্বাধীন সরকার পাবে। এনপিপির জ্যেষ্ঠ নেতা ও সংসদ সদস্য হরিণী অমরাসুরিয়া বলেছেন, এটা পরিবর্তনের ভোট। আমরা যে প্রচার চালিয়ে আসছি, সেটাকেই নিশ্চিত করছে ভোটের ফলাফল। আমরা মানুষের কাছে বিদ্যমান রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে আমূল পরিবর্তনের কথা বলেছি।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, অর্থনৈতিক দুর্দশা থেকে উত্তরণের আশায় অনূঢ়া কুমারা দিশানায়েকেকে ভোট দিয়েছেন মানুষ। এখন তার বড় কাজ হবে নজিরবিহীন অর্থনৈতিক সংকট থেকে দেশকে টেনে তোলা। ফলে নতুন প্রেসিডেন্টের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হবে অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা ফেরানো। এখন দিশানায়েকে দেশটির মানুষকে কতটা দিশা দেখাতে পারেন, সেটাই দেখার বিষয়।

সূত্র: বিবিসি. আলজাজিরা, রয়টার্স

– দৈনিক পঞ্চগড় নিউজ ডেস্ক –