• শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

  • || ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫

দেবীগঞ্জে ‘দিনমজুর দম্পতির একঘরে’ ঘটনায় তদন্তের নির্দেশ আদালতের 

প্রকাশিত: ১৪ আগস্ট ২০২১  

পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জ উপজেলার দিনমজুর আয়নাল ও জামিরন দম্পতিকে দুই মাস একঘরে করে রাখার ঘটনাটি বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলে তা আমলে নিয়ে তদন্তের নির্দেশন দিয়েছেন আদালত। 

গত ১১ আগস্ট পঞ্চগড়ের অতিরিক্ত চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মো. মতিউর রহমান দি কোর্ট অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউর বিষয়টিকে আমলে নেন। একই সঙ্গে আগামী ২২ আগস্টের মধ্যে বিচারক দেবীগঞ্জ থানার ওসিকে বিষয়টি সঠিকভাবে তদন্ত করে আদালতে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেয়।

আদালতের আদেশ নামায় উল্লেখ করা হয়, হিল্লা বিয়েতে রাজি না হওয়ায় পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জ উপজেলার এক দিনমজুর দম্পতিকে দীর্ঘদিন একঘরে করে রাখার সংবাদটি বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয় এবং সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। 

মুসলিম বিবাহ ও তালাক সম্পাদিত হয় মুসলিম শরিয়াহ আইনের নির্ধারিত বিধিবিধানের আলোকে। শরিয়াহ আইনের মূল ভিত্তিহলো পবিত্র কোরআন ও সহিহ হাদিস। কোরআন ও সহিহ হাদিসের নির্ধারিত বিধি বিধানের আলোকে একজন মুৃসলিম এক বৈঠকে বা এক সঙ্গে একাধিকবার তালাক শব্দটি উচ্চারণ করলেও তা এক তালাক হিসেবে গণ্য হবে। কখনো তিন তালাক হবে না। এক্ষেত্রে স্বামী-স্ত্রীর পুনরায় আপোষ সমঝোতায় পুনরায় বিয়ে ছাড়াই সংসার করতে বাধা থাকবে না। 

আলোচ্য ঘটনায় দেখা যাচ্ছে যে, দেবীগঞ্জ উপজেলার সুন্দরদিঘী ইউপির সলিমনগর গ্রামের স্থানীয় সমাজপতি ও ধর্মীয় নেতারা মনগড়া ফতোয়া জারি করে সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে ওই গ্রামের আয়নাল হক ও জামিরন বেগম দম্পতিকে একঘরে করে রেখেছে। বাংলাদেশের উচ্চ আদালতের সিদ্ধান্ত ও প্রচলিত আইন অনুযায়ী যা অসিদ্ধ ও গুরুতর অপরাধ। 

দেবীগঞ্জ থানার ওসি জামাল হোসেন বলেন, আদালতের নির্দেশনা আমার কাছে এসেছে। আমরা এরই মধ্যে তদন্ত শুরু করেছি। নির্ধারিত সময়ে তদন্ত শেষ করে আদালতে প্রতিবেদন জমা দিতে পারবো বলে আশা করছি। 

৩৫ বছর সংসার করার পর গত রমজান মাসে পারিবারিক কলহের জের ধরে সুন্দরদিঘী ইউপির সলিমনগর এলাকার দিনমজুর আয়নাল হক রাগের মাথায় তার স্ত্রী জামিরন বেগমকে তিন তালাক দেন। তাদের সংসারে দুই ছেলে ও দুই মেয়ে রয়েছে। বিষয়টি জানাজানি হলে সমাজের অবরোধের মুখে পড়েন তারা। সমাজের চাপে পড়ে আরেক বার স্ত্রীকে ধর্মীয় মতে বিয়ে করে নেন। তারপরও তা মানতে নারাজ সলিমনগর জামে মসজিদের সমাজপতিরা। 

স্থানীয় হাফেজ মোস্তফা কামাল ফতোয়ার জন্য ডেকে আনেন ফুলবাড়ি এলাকার মুফতি আনোয়ার হোসাইনকে। আনোয়ার হোসাইন ফতোয়া দেন হিল্লে বিয়ে ছাড়া ওই দম্পতি এক সঙ্গে থাকতে পারবেন না। হিল্লে বিয়ে না দিলে তারা যে পাপ করবে তা সমাজের সবাইকে বহন করতে হবে। তাই রাজি না হলে একঘরে করে দেয়ার ফতোয়া দেয় ওই মুফতি। 

এই ফতোয়ার পর ওই মসজিদ কমিটির সভাপতি নাসির উদ্দিন, সাধারণ সম্পাদক মোমিনুর ইসলাম, আব্দুল মোতালেব, হাফেজ মোস্তফা কামাল, মুফতি আনোয়ার হোসাইন, স্থানীয় অধিবাসী শাহজাহান আলী, আমির চাঁন, সুরমান, জুলহাস, রাসেল, সহিদ আলী সম্মিলিতভাবে প্রায় দুই মাস আগে ওই দিনমজুর পরিবারটিকে একঘরে করে দেন। তাদের সঙ্গে কেউ যেন মেলামেশা না করে সেজন্য কঠোর সতর্কতা জারি করা হয়। কেউ মেলামেশা করলে তাকে ৫০০ টাকা করে জরিমানা করা হবে বলেও ঘোষণা দেয় তারা। 

তারপর থেকে পরিবারটির ওপর নেমে আসে অমানবিক নির্যাতন। হাট বাজার থেকে শুরু করে পথঘাট সর্বত্রই লাঞ্ছিত হতে থাকে পরিবারটি। নিজের ছেলে নাতি নাতনিদের সঙ্গে দেখা করতে পারতেন না তারা। সামাজের ভয়ে কেউ আয়নালকে কাজেও নেয় নি। দুই মাস তাকে বেকার হয়ে খেয়ে না খেয়ে বাড়িতেই কাটাতে হয়েছে। দুই মাস ধরে পরিবারটি সামাজপতিদের দ্বারে দ্বারে সহানুভূতি ভিক্ষে করলেও কেউ তাদের পাশে দাঁড়ায়নি। এমনকি স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরাও বিষয়টি সমাধানে ব্যর্থ হয়। 

নিরুপায় পরিবারটি গত সোমবার এ বিষয়ে ১০ জনের নাম উল্লেখ করে ইউএনও বরাবরে লিখিত অভিযোগ করে। অভিযোগের পর বৃহস্পতিবার বিকেলে সলিমনগর উচ্চ বিদ্যালয়ে সবাইকে নিয়ে সমঝোতা বৈঠক করে উপজেলা প্রশাসন। এ সময় ইউএনও প্রত্যয় হাসান ও দেবীগঞ্জ থানার ওসি জামাল হোসেনসহ স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। এ সময় প্রশাসনের চাপে পড়ে ওই দিনমজুরকে সমাজে ফিরিয়ে নিতে রাজি হয় সমাজপতিরা। কিন্তু প্রশাসনের লোকজন চলে যাওয়ার পর আবারো শুরু হয় হুমকি ধামকি। তাদের দাবি প্রশাসনের চাপে মেনে নিলেও তারা ধর্মীয় বিধানে তাকে মেনে নেয় নি।

এ বিষয়ে গত ১৩ আগস্ট একটি জাতীয় পত্রিকায় ‘হিল্লা বিয়েতে ‘না’ একঘরে দম্পতি” শিরোনামে খবর প্রকাশিত হয়। 

– দৈনিক পঞ্চগড় নিউজ ডেস্ক –