• মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ৩ ১৪৩১

  • || ০৬ শাওয়াল ১৪৪৫

মুজিব দর্শনে উন্নত বাংলাদেশ এবং শেখ হাসিনা

প্রকাশিত: ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২১  

ড. মো. নাছিম আখতার 

দর্শন হচ্ছে সামাজিক চেতনার সেই রূপ, যা প্রকৃতি বিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞানের সমন্বয় সাধন করে। যে জাতির দর্শন যতটা ইতিবাচক, সে জাতি ততটা উন্নত। বঙ্গবন্ধু ছিলেন ইতিবাচক দর্শনের ধারক ও বাহক। মহান এই মানুষটির দর্শনের মধ্যেই নিহিত উন্নত বাংলাদেশের রূপরেখা। তাঁর সুযোগ্য কন্যা পিতার অসমাপ্ত কাজগুলো সম্পন্ন করছেন। দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন উন্নয়নের পথে।

শিক্ষার বিষয়ে বঙ্গবন্ধু ছিলেন অত্যন্ত সচেতন একজন মানুষ। তাঁর প্রতি বাবা শেখ লুত্ফর রহমানের উপদেশ বাণী তিনি হুবহু তুলে ধরেছেন তাঁর লেখা ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ বইটিতে। তাঁর বাবা বলেছিলেন,  ‘বাবা, রাজনীতি কর আপত্তি করব না, পাকিস্তানের জন্য সংগ্রাম করছ এ তো সুখের কথা, তবে লেখাপড়া করতে ভুলিও না। লেখাপড়া না শিখলে মানুষ হতে পারবে না।’ বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, বাবার এই কথা তিনি সারা জীবন অক্ষরে অক্ষরে পালন করে গেছেন। দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭২ সালে এ দেশের শিক্ষাকে যুগোপযোগী করতে তিনি ড. কুদরাত-এ খুদা শিক্ষা কমিশন গঠন করেন। বঙ্গবন্ধু সরকারের সময় ৩৬ হাজার ১৬৫টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে জাতীয়করণ করা হয়। এই সময় বাড়ানো হয় শিক্ষকদের বেতন। ১৯ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২ সালে একটি প্রেস নোটের মাধ্যমে প্রথম শ্রেণি থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা বিনা মূল্যে বই পাবে বলে ঘোষণা করা হয়। ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা বই পাবে বাজারমূল্যের চেয়ে ৪০ শতাংশ কম মূল্যে। নারীর উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নের উদ্দেশ্যে ১৯৭৩ সালে জানুয়ারি মাসে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত নারীদের অবৈতনিক শিক্ষা চালু করার যুগান্তকারী পদক্ষেপ নিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। দেশকে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিতে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের উপযোগী জনবল তৈরিতে নিরন্তর কাজ করে যাচ্ছেন। তিনি ডিজিটাল বাংলাদেশের প্রবর্তক। সঙ্গে সঙ্গে উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার সুযোগ সৃষ্টিতে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছেন, যা দেশের উচ্চশিক্ষাকে অনন্য মাত্রায় নিয়ে যাবে।

১৩ সেপ্টেম্বর ১৯৭৪ সালে তখনকার গণভবনে বঙ্গবন্ধুর সামনের টেবিলে একটি যন্ত্র ও পাশে দুজন ব্যক্তি দাঁড়িয়ে ছিলেন। একজন হলেন মো. জাফর আলী এবং অন্যজন মো. আবদুল হক। দুজনেই কাজ করেন লতিফ বাওয়ানি জুট মিলে। দুজনের কারো ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি নেই। তবু তাঁদের মেধা ও সৃজনশীলতা দিয়ে বাংলাদেশেই তৈরি করেছেন জুট মিলের জন্য প্রয়োজনীয় একটি যন্ত্র ‘অয়েল এক্সট্রাক্ট অ্যাপারেটাস’। যুগান্তকারী কোনো বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার এটি ছিল না। সেই সময় বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করে যন্ত্রটি বিদেশ থেকে আমদানি করা হতো। তখন বৈদেশিক মুদ্রার সংকট ছিল। বঙ্গবন্ধু এই যন্ত্রটি দেখে খুব খুশি হন এবং তাঁদের উদ্ভাবনী শক্তি ও কারিগরি জ্ঞানের ভূয়সী প্রশংসা করেন। রাষ্ট্রীয় কাজে শত ব্যস্ততার মাঝেও বঙ্গবন্ধু তাঁদের সময় দিয়েছিলেন শুধু প্রশংসা করার জন্য নয়, বরং অন্যরাও যাতে উৎসাহিত হয়ে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি খাতে বিভিন্ন জিনিস আবিষ্কার করেন। বঙ্গবন্ধুর বিজ্ঞানভাবনার এই দর্শনকে তাঁর সুযোগ্যা কন্যা মনে-প্রাণে ধারণ করেন। তাইতো মেধাবীদের গবেষণার ক্ষেত্রে তাঁর সরকার দেশে ও বিদেশে বিভিন্ন শিক্ষাবৃত্তি ও গবেষণাবৃত্তি প্রদানের ব্যবস্থা করেছে। তাঁর শাসনামলেই বাঙালি জাতির হারানো গৌরবের ঐতিহ্য মসলিন শাড়ি আবারও বিশ্ববাজারে ফিরে আসছে।

২০  মার্চ ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম সমাবর্তন উৎসব সপ্তাহের উদ্বোধনকালে বলেন, ‘বৈজ্ঞানিক ও কারিগরি শিক্ষার মাধ্যমে দেশকে গড়ে তোলা সম্ভব হবে।’ প্রকৃতপক্ষে দেশ গড়ার জন্য বঙ্গবন্ধুর ভাবনায় বিজ্ঞান ও কারিগরি বিষয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। বর্তমান সরকার কারিগরি শিক্ষার প্রসারকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছে। বিশ্লেষণী দৃষ্টি দিয়ে দেখলে একটি বিষয় পরিষ্কার, তা হলো বিশ্বের জি-৭ শিল্পোন্নত দেশগুলোর অঙ্কের পারদর্শিতার অবস্থান এক থেকে ৩০-এর মধ্যে। সুতরাং বোঝা যাচ্ছে কারিগরি শিক্ষা ও শিল্পের সঙ্গে গণিতের নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। বর্তমানে যে দেশগুলো শিল্পে এগিয়ে যাচ্ছে, যেমন—চায়না ও দক্ষিণ কোরিয়া। এ দেশগুলো কিন্তু অঙ্কের পারদর্শিতার অবস্থানে জি-৭-এর অন্য দেশগুলোকে পেছনে ফেলেছে। এদের অবস্থানও অঙ্কের পারদর্শিতায় যথাক্রমে প্রথম ও সপ্তম। আমাদের দেশের কারিগরি শিক্ষা ও উদ্ভাবনকে এগিয়ে নিতে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে গণিতের ক্ষেত্রে অনুসরণ করতে হবে গণিতে পারদর্শী দেশগুলোর অঙ্ক শিখনের কৌশল। অন্যথায় কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত মানুষের সংখ্যামান বাড়লেও গুণগত মান কখনোই বিশ্বমানের হবে না। ফলে সার্বিক উন্নয়নের পরিকল্পনা ব্যাহত হবে।

স্বাধীন বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয়ভাবে বঙ্গবন্ধুই সর্বপ্রথম আইন করে মদ, জুয়াসহ অনৈতিক বিভিন্ন কার্যকলাপ নিষিদ্ধ করেছেন। বঙ্গবন্ধু আজীবন মাদকের বিরুদ্ধে লড়াই করে গেছেন। মাদকদ্রব্য সেবন যেখানে সমাজের উচ্চ শ্রেণির মানুষের শৌখিনতা, বঙ্গবন্ধু সেখানে মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন। বর্তমান সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাবার পথ অনুসরণ করছেন মাদকের বিস্তার রোধে। নানা পদক্ষেপ নিয়েছেন যুবসমাজকে মাদকের হাত থেকে রক্ষা করতে। বর্তমানে সরকারি চাকরি থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়েও ডোপ টেস্টের ব্যবস্থা রাখা হচ্ছে। মাদক নির্মূল করতে চীনের আফিম যুদ্ধের ইতিহাস যুবসমাজের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে হবে। তাহলে নবপ্রজন্ম বুঝতে পারবে চীনের মতো একটি শক্তিশালী ও বুদ্ধিমান জাতিকে কিভাবে আন্তর্জাতিকচক্র মাদকাসক্ত জাতিতে রূপান্তরিত করেছিল শুধু নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য। বর্তমানে আফ্রিকার জনগণকেও মাদকের নেশায় বুঁদ রেখে পশ্চিমারা আফ্রিকার সম্পদ লুটে নিচ্ছে।

বঙ্গবন্ধু ছিলেন সৎ, নিষ্ঠাবান ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার একজন শুদ্ধ রাজনীতিবিদ। স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে দেশের ভৌত অবকাঠামো, মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নসহ দেশ এখন নিম্নমধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে। কিন্তু দুর্নীতির বিস্তার সর্বাত্মকভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। এর প্রভাব সার্বিক অর্থনীতি, আইন-শৃঙ্খলা, দক্ষ জনবল তৈরি এমনকি টেকসই উন্নয়নের ওপরও পরিলক্ষিত হচ্ছে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুর্নীতির লাগাম টানতে দেশের সরকারি সেবা খাতগুলোকে প্রযুক্তিনির্ভর অবকাঠামোর মধ্যে নিয়ে আসার নির্দেশনা দিয়েছেন। দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি অবলম্বন করেছেন। দুর্নীতি দমন কমিশনকে করেছেন শক্তিশালী।

সর্বোপরি আমরা দেশের যে উন্নয়ন দেখছি তা মুজিব দর্শনে উন্নত বাংলাদেশের ভাবনার প্রতিফলন। এই ভাবনা বাস্তবায়নের একনিষ্ঠ  কারিগর  বঙ্গবন্ধুর  সুযোগ্য  কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাই সময়ের পরিক্রমায় প্রমাণিত হয় ‘রক্ত কথা বলে’।

 লেখক : উপাচার্য, চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
 

– দৈনিক পঞ্চগড় নিউজ ডেস্ক –