• শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ১৪ ১৪৩০

  • || ১৮ রমজান ১৪৪৫

মদিনা সনদে সম্প্রীতি ও সংহতির অঙ্গীকার

প্রকাশিত: ২৫ নভেম্বর ২০২১  

মদিনায় হিজরতের পর বিকাশমান মুসলিম সমাজ ও ইসলামী রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার কথা ভেবে মহানবী (সা.) মদিনাবাসীর কাছ থেকে সংহতি, পারস্পরিক সহযোগিতা ও সম্প্রীতির অঙ্গীকার গ্রহণ করেন, যা মদিনার সামাজিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ইতিহাসে যাকে মদিনা সনদ বলা হয়। উপমহাদেশের বরেণ্য সিরাত গবেষক আল্লামা ইদরিস কান্ধলভি (রহ.) এর কারণ অনুসন্ধান করে বলেছেন, ‘এটি মুসলিম ও জিম্মিদের (অমুসলিম দেশের অমুসলিম নাগরিক) মধ্যকার অন্যান্য চুক্তির মতো একটি চুক্তি। তবে পুরোপুরি তেমন ছিল না। কেননা তা সেটা হিজরতের পর ইসলামের উত্থান ও নেতৃত্বের একেবারেই প্রাথমিক সময়ে সংঘটিত হয়েছে।’ (সিরাতে মোস্তফা : ১/৪৪০)

আল্লামা ইবনে হিশাম (রহ.) বলেন, ‘অতঃপর রাসুলুল্লাহ (সা.) আনসার ও মুহাজিরদের মধ্যে একটি ঘোষণাপত্র সম্পাদন করেন। এই দলিলের মাধ্যমে তিনি ইহুদিদের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের প্রতিশ্রুতি প্রদান ও গ্রহণ করেন, তাদের ধর্মপালনের স্বাধীনতা ও ধন-সম্পদে তাদের মালিকানার স্বীকৃতি দেন।’ (সিরাতে ইবনে হিশাম, পৃষ্ঠা ১৪০)

মদিনায় ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্রের বিকাশে প্রধান অন্তরায় ছিল ইহুদিরা। কেননা তারা ছিল অস্ত্রধারী যুদ্ধবাজ, অর্থনীতি এবং জীবন-জীবিকার দিক থেকেও তারা মুসলমানদের চেয়ে সমৃদ্ধ ছিল। হিজরতের আগে মুসলমান ও মক্কার কুরাইশদের মধ্যকার সমস্যার ক্ষেত্রে তাদের কোনো পক্ষপাত ছিল না। কিন্তু নবী (সা.) যখন মদিনায় আসেন, তখন তাদের কায়েমি স্বার্থে কুঠারাঘাত পড়ে। এ ছাড়া মদিনার অধিবাসীদের একটি শ্রেণি মুনাফিকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। চাতুর্য, চাটুকারিতা ও ধ্বংসাত্মক কার্যক্রম ছিল তাদের অবলম্বন। মুনাফিকদের ভেতর আবদুল্লাহ ইবনে উবাই ইবনে সালুলের নাম সর্বাগ্রে উচ্চারিত হয়। মহানবী (সা.) মদিনায় হিজরত করার আগে তাকে মদিনার শাসক মনোনীত করার আলোচনা চলছিল। ফলে সে নবীজি (সা.)-কে তার স্বপ্নভঙ্গের জন্য দায়ী মনে করত এবং প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে নানা ধরনের ষড়যন্ত্রমূলক কাজে লিপ্ত ছিল। মদিনা সনদ ইহুদি ও মুনাফিকদের শত্রুতা ও ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে একটি কার্যকর পদক্ষেপ ছিল। (মুসলিম উম্মাহর ইতিহাস : ২/৩২-৩৩)

সিরাত গ্রন্থগুলোতে মদিনা সনদের বিভিন্নসংখ্যক ধারা উল্লেখ করা হয়েছে। ড. আলী মুহাম্মদ সাল্লাবি মদিনা সনদের ৪৬টি ধারা উল্লেখ করেছেন। আল্লামা শফিউর রহমান মোবারকপুরী মুসলমান ও ইহুদিদের পৃথক পৃথক অঙ্গীকারের ধারা উল্লেখ করেছেন। তাঁর বর্ণনামতে মুসলিমরা পরস্পরের প্রতি ১৬টি অঙ্গীকার এবং মুসলিম ও ইহুদিরা পরস্পরের প্রতি ১২টি অঙ্গীকার করেন। মুসলিমরা যেসব বিষয়ে অঙ্গীকার করেন তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো—

১. মুসলিমরা একটি স্বতন্ত্র জাতি হিসেবে বিবেচিত হবে।

২. কোরাইশরা মুহাজিররা এবং মদিনার আনসাররা তাদের পূর্ব নিয়ম অনুযায়ী পারস্পরিক মুক্তিপণ আদায় করবে। উভয় শ্রেণি মুমিনদের মধ্যে সুবিচারমূলকভাবে বন্দিদের ফিরিয়ে দেবে।

৩. প্রচলিত রীতি অনুযায়ী মুমিনরা ফিদিয়া ও মুক্তিপণের ক্ষেত্রে পরস্পরকে দান ও উপহার থেকে বঞ্চিত করবে না।

৪. যারা বাড়াবাড়ি, অবিচার, হাঙ্গামা ও পাপে লিপ্ত হবে, সব মুমিন তার বিরোধিতা করবে।

৫. মুমিনরা পরস্পরকে কোনো কাফিরকে হত্যার অভিযোগে হত্যা করবে না।

৬. যেসব ইহুদি আমাদের আদর্শে দীক্ষিত হবে, তাদের সাহায্য করা হবে এবং তারা অন্য মুসলমানের মতোই ব্যবহার পাবে।

৭. কোনো মুসলমানই কাফের কুরাইশদের কারো জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তা দিতে পারবে না। কোনো কুরাইশ কাফের মুসলমানের কাছে জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তা চাইতে পারবে না।

৮. মুমিনরা পরস্পরের বিরোধিতায় লিপ্ত হবে না। তোমাদের মধ্যে কোনো বিষয়ে মতবিরোধ হলে সে বিষয়ে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের নির্দেশ অনুযায়ী মীমাংসা করা হবে।

একইভাবে ইহুদি ও মুসলিমদের মধ্যে একটি অঙ্গীকারনামা ও চুক্তি সংঘটিত হয়। সে চুক্তির অন্যতম ধারাগুলো হলো—

১. বনু আউফের ইহুদিরা মুসলমানদের সঙ্গে মিলিত হয়ে একই উম্মত বিবেচিত হবে। ইহুদি ও মুসলমানরা নিজ নিজ দ্বিনের ওপর আমল করবে। বনু আউফ ছাড়া অন্য ইহুদিরাও একই রকম অধিকার ভোগ করবে।

২. ইহুদিরা নিজেদের সমুদয় ব্যয়ের জন্য দায়ী হবে এবং মুসলিমরা নিজেদের ব্যয়ের জন্য পৃথক পৃথকভাবে দায়ী হবে।

৩. এই চুক্তির আওতাভুক্তদের কোনো অংশের সঙ্গে যারা যুদ্ধ করবে সবাই সম্মিলিতভাবে তাদের প্রতিহত করবে।

৪. এই চুক্তির অংশীদাররা পরস্পরের কল্যাণ কামনা করবে। তবে সেই কল্যাণ কামনা ও সহযোগিতা ন্যায়ের ওপর প্রতিষ্ঠিত হতে হবে, অন্যায়ের ওপর নয়।

৫. কোনো ব্যক্তি তার মিত্রের কারণে অপরাধী বিবেচিত হবে না।

৬. যত দিন ধরে যুদ্ধ চলবে, তত দিন ইহুদিরাও মুসলিমদের সঙ্গে যুদ্ধের ব্যয়ভার বহন করবে।

৭. এই চুক্তির অংশীদারদের জন্য মদিনায় দাঙ্গা-হাঙ্গামা ও রক্তপাত নিষিদ্ধ থাকবে।

৯. এই চুক্তির অংশীদারদের মধ্যে কোনো নতুন সমস্যা দেখা দিলে বা ঝগড়া-বিবাদ হলে আল্লাহর আইন অনুযায়ী রাসুলুল্লাহ (সা.) তার মীমাংসা করবেন। (আর-রাহিকুল মাখতুম, পৃষ্ঠা ১৯৬ ও ২০০; আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা, পৃষ্ঠা ৩২৪)

ইমাম আবু জাহরা (রহ.) মদিনা সনদের চারটি বৈশিষ্ট্য ও উপকার উল্লেখ করেছেন। তা হলো—

এক. রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর একক নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা : মদিনার ইতিহাসে প্রথমবারের মতো নবী কারিম (সা.) মদিনার সব গোত্র ও পক্ষকে সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে একত্র করতে পেরেছিলেন।

দুই. ইহুদি কর্তৃত্বের অবসান : এই অঙ্গীকারের মাধ্যমে মদিনায় যুগ যুগ ধরে চলে আসা ইহুদি কর্তৃত্বের অবসান ঘটে। তাদের বিষয়ে আল্লাহ তাআলা মহানবী (সা.)-কে পূর্ণাঙ্গ ইচ্ছাধিকার দিয়েছিলেন। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘যদি তারা আপনার কাছে আসে তবে তাদের মধ্যে ফায়সালা করে দিন অথবা তাদের উপেক্ষা করুন। যদি তাদের উপেক্ষা করেন, তবে তারা আপনার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। আর যদি আপনি তাদের মধ্যে ফায়সালা করেন তবে ন্যায়বিচার করুন। নিশ্চয়ই আল্লাহ ন্যায়বিচারকারীদের ভালোবাসেন।’ (সুরা মায়িদা, আয়াত : ৪৬)

তিন. সামাজিক মৈত্রী প্রতিষ্ঠা : এই চুক্তি ও অঙ্গীকারের ভিত্তি ছিল পারস্পরিক সহযোগিতা ও সহমর্মিতার ওপর। যেন মদিনার সব অধিবাসী একই পরিবারভুক্ত।

চার. সামাজিক সুবিচার প্রতিষ্ঠা : এই চুক্তি ছিল অন্যায় প্রতিরোধ করে একটি ন্যায়ভিত্তিক শান্তিপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠার। (খাতামুন নাবিয়্যিন, পৃষ্ঠা ৪৯৯)

– দৈনিক পঞ্চগড় নিউজ ডেস্ক –