• শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

  • || ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫

আল-কোরআনে নিষিদ্ধ সুদের স্বরূপ

প্রকাশিত: ২৮ জুন ২০২১  

ইসলামে সুদ হারাম ঘোষণা করা হয়েছে। আল-কোরআন ও হাদিসে সুদকে কঠিন গুনাহের কাজ বলে অভিহিত করা হয়েছে। সুদ বা রিবার আভিধানিক অর্থ বৃদ্ধি, প্রবৃদ্ধি, আধিক্য, অতিরিক্ত ইত্যাদি। তবে সব ধরনের বৃদ্ধি সুদের অন্তর্ভুক্ত নয়। ‘বিরা’ শুধু এমন অতিরিক্ত অর্থ বা পণ্য, যার বিপরীতে কোনো বিনিময় থাকে না। সুদের অনেক সংজ্ঞার মধ্যে সর্বশেষ পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্টের শরিয়াহ আপিল বেঞ্চের সংজ্ঞাটি নিম্নরূপ : ভোগ বা উৎপাদন যে উদ্দেশেই হোক, নির্বিশেষে সব উণ বা দেনার চুক্তিতে আসলের ওপর ধার্যকৃত কম বা বেশি হোক, যেকোনো অতিরিক্তই হচ্ছে আল-কোরআনে নিষিদ্ধ সুদ বা রিবা। রিবা দুই প্রকার। রিবা আন-নাসিয়াহ ও রিবা আল-ফাদাল।

আরবি ‘নাসিআহ’ শব্দের অর্থ মেয়াদ বা অবকাশ, স্থগিত বা বিলম্ব, পরিশোধে বিলম্ব, পরিশোধের জন্য প্রদত্ত সময়, বাকি, ধার ইত্যাদি। কাজেই ‘রিবা আন-নাসিআহ’ অর্থ মেয়াদি ঋণের সুদ। পরিভাষায় ঋণের ওপর চুক্তির শর্ত অনুসারে শরিআহসম্মত কোনো বিনিময় ছাড়া যে অতিরিক্ত অর্থ বা মাল আদায় করা হয় তাকে ‘রিবা আন-নাসিআহ’ বা মেয়াদি ঋণের সুদ বলা হয়।

চুক্তির শর্ত অনুসারে ঋণের আসলের অতিরিক্ত যা-ই নেওয়া হোক না কেন তা-ই হচ্ছে ‘রিবা আন-নাসিআহ’। এই অতিরিক্ত হতে পারে কোনো অর্থ, হতে পারে কোনো পণ্য। এমনকি তা কোনো সেবা, উপহার, উপঢৌকন আকারেও হতে পারে। যেমন—কেউ যদি ৫০০ টাকা এই ঋণ দেয় যে ঋণগ্রহীতা ছয় মাস পর ৫০০ টাকার সঙ্গে অতিরিক্ত ৫০ টাকা বেশি দেবে অথবা এই ৫০০ টাকার অতিরিক্ত ১০ কেজি আলু দেবে তাহলে অতিরিক্ত ৫০ টাকা বা ১০ কেজি আলু রিবা আন-নাসিআহ হিসেবে গণ্য হবে।

সাধারণত ঋণ বা ধারের ক্ষেত্রে ‘রিবা আন-নাসিআহ’র উদ্ভব হয়। ঋণের চুক্তিতে মূলধনের ওপর পূর্বশর্ত মোতাবেক যেকোনো বৃদ্ধিই হচ্ছে ‘রিবা আন-নাসিআহ’। সরাসরি আল-কোরআনের আয়াতের মাধ্যমে ‘রিবা আন-নাসিআহ’কে হারাম করা হয়েছে বলে একে ‘রিবা আল-কোরআন’ বলা হয়। আবার জাহিলি যুগে এই রিবার প্রচলন ছিল বলে একে ‘রিবা আল-জাহিলিয়াহ’ও বলা হয়। বিভিন্নভাবে ‘রিবা আন-নাসিআহ’ সংঘটিত হতে পারে। নিচে এর কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া হলো :

অর্থ ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে রিবা আন-নাসিআহ : ঋণের আসলের ওপর চুক্তির শর্ত মোতাবেক অতিরিক্ত ধার্য করা হলে তাকে রিবা আন-নাসিআহ বলা হয়। যেমন—এক ব্যক্তি অপর ব্যক্তিকে ১০ হাজার টাকা এক বছরের জন্য এই শর্তে ঋণ দিল যে সময় শেষে ঋণগ্রহীতা ঋণদাতাকে আসলের সঙ্গে ৫ শতাংশ অতিরিক্ত; অর্থাৎ আরো ৫০০ টাকা বেশি ফেরত দেবে। এ ক্ষেত্রে অতিরিক্ত ৫ শতাংশ বা ৫০০ টাকা ‘রিবা আন-নাসিআহ’ হিসেবে গণ্য হবে।

পণ্য ধার দেওয়ার ক্ষেত্রে রিবা আন-নাসিআহ : সমজাতীয় পণ্য ধার দিয়ে তার ওপর অতিরিক্ত আদায় করাও সুদ। যেমন—ঋণদাতা যদি ঋণগ্রহীতাকে ২০ কেজি চাল এই শর্তে ধার দেয় যে ছয় মাস পর ঋণগ্রহীতা ২৫ কেজি চাল ফেরত দেবে, তাহলে অতিরিক্ত পাঁচ কেজি চাল হবে ‘রিবা আন-নাসিআহ’।

বাকিতে কেনাবেচার বেলায় রিবা আন-নাসিআহ : কারো কাছে বাকিতে পণ্য বিক্রির পর নির্ধারিত সময়ে ক্রেতা মূল্য পরিশোধ করতে ব্যর্থ হলে সময় বাড়িয়ে দিয়ে আসলের অতিরিক্ত অর্থ বা মাল আদায় করাও রিবা আন-নাসিআহর অন্তর্ভুক্ত। যেমন—এক ব্যক্তি অন্য ব্যক্তির কাছে পাঁচ মণ ধান তিন হাজার টাকায় ভবিষ্যতের নির্দিষ্ট সময়ে মূল্য পরিশোধের শর্তে বাকিতে বিক্রি করল। কিন্তু নির্দিষ্ট সময়ে ক্রেতা ধানের মূল্য পরিশোধে ব্যর্থ হলো। এখন ক্রেতা ও বিক্রেতা উভয়ের সম্মতিক্রমে মূল্য পরিশোধের সময় বাড়িয়ে ঋণের পরিমাণ তিন হাজার ৫০০ টাকা করা হলো। এখানে অতিরিক্ত ৫০০ টাকা সুদ হিসেবে গণ্য হবে।

রিবা আল-ফাদাল : আরবি ‘ফাদাল’ শব্দের অর্থ হচ্ছে অতিরিক্ত, বাড়তি, বেশি ইত্যাদি। পরিভাষায় পণ্য বা অর্থের বিনিময়ে অতিরিক্ত পণ্য বা অর্থই রিবা আল-ফাদাল। যেমন—এক দিনারের বিনিময়ে দুই দিনার। ফিকহশাস্ত্রে নগদ কেনাবেচার ক্ষেত্রে উদ্ভূত যাবতীয় ‘রিবাকে রিবা আল-ফাদাল’ বলে। কাজেই ‘রিবা আন-নাসিআহ’র মতো ঋণ বা ধারদেনার ক্ষেত্রে নয়; বরং নগদ বিনিময় ও কেনাবেচার ক্ষেত্রে রিবা আল-ফাদালের উদ্ভব ঘটে। এই রিবার ক্ষেত্রে সময় নেই; বরং বৃদ্ধি আছে। তাই একে ‘রিবা আল-ফাদাল’ নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে।

নগদ বিনিময় ও কেনাবেচার ক্ষেত্রে ‘রিবা আল-ফাদালে’র উদ্ভব ঘটে বলে একে রিবা আল-বুয়ু বা কেনাবেচার রিবা বলা হয়। আবার কেউ কেউ একে রিবা আন-নকদ বা নগদ রিবা বলে উল্লেখ করেছেন। ‘রিবা আল-ফাদাল’ সম্পর্কে প্রসিদ্ধ হাদিস হলো, মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘সোনার বিনিময়ে সোনা, রুপার বিনিময়ে রুপা, গমের বিনিময়ে গম, যবের বিনিময়ে যব, খেজুরের বিনিময়ে খেজুর এবং লবণের বিনিময়ে লবণ—যদি আদান-প্রদান করো, তাহলে সমান সমান এবং হাতে হাতে বা নগদে নগদে হতে হবে। বেশি-কম করলে বা বাকিতে করলে, তা সুদি কারবার হিসেবে গণ্য হবে। এতে দাতা ও গ্রহীতা উভয়ে সমান গুনাহগার হবে। নিচে এর কিছু উদাহরণ দেওয়া হলো :

সমজাতীয় মুদ্রা বিনিময়ের ক্ষেত্রে রিবা আল-ফাদাল : মুদ্রার বিনিময়ে মুদ্রা লেনদেনের ক্ষেত্রে উভয় মুদ্রা যদি একই জাতীয় ও একই শ্রেণিভুক্ত হয়, তাহলে লেনদেন নগদে ও পরিমাণে সমান সমান হতে হবে। এ ক্ষেত্রে মুদ্রার বিনিময় কম-বেশি বা বাকিতে করা হলে রিবা হবে। যেমন—এক দিরহামের বিনিময়ে দুই দিরহাম বিক্রি করা।

সমজাতীয় পণ্য বিনিময়ের ক্ষেত্রে রিবা আল-ফাদাল : সমজাতীয় পণ্য বিনিময়ের ক্ষেত্রে যে অতিরিক্ত নেওয়া বা দেওয়া হয় তা রিবা বা সুদ। সমজাতীয় পণ্য কমবেশি করে বিনিময়ের ক্ষেত্রে রিবা আল-ফাদাল সংঘটিত হয়। যেমন—এক কেজি উন্নতমানের খেজুরের সঙ্গে দুই কেজি নিম্নমানের খেজুর বিনিময় করা হলে এখানে নিম্নমানের খেজুরের অতিরিক্ত এক কেজি হবে ‘রিবা আল-ফাদাল’।

অসমজাতীয় পণ্য কেনাবেচার ক্ষেত্রে রিবা আল-ফাদাল : পণ্য বিনিময়ের ক্ষেত্রে উভয় পণ্য যদি ভিন্ন ভিন্ন জাতীয় ও শ্রেণিভুক্ত হয় এবং উভয় পণ্য যদি ওজন ও পরিমাপযোগ্য হয় আর একপক্ষ যদি তার পণ্য বাকিতে সরবরাহ করে, তাহলে এ লেনদেন সুদের অন্তর্ভুক্ত হবে। যেমন—কেউ পাঁচ ভরি সোনার বিনিময়ে ১০০ ভরি রুপা কিনতে চায়। এ ক্ষেত্রে সোনা ও রুপা হাতে হাতে বিনিময় হতে হবে। উভয় পণ্যের কোনো একটি বাকিতে সরবরাহ করা হলে হাদিসের আলোকে তা সুদি লেনদেনে পরিণত হবে।

সুদ জঘন্য অপরাধ। সুদের ধর্মীয়, সামাজিক, নৈতিক ও অর্থনৈতিক কুফল মারাত্মক। তাই সুদ সম্পর্কে সবার ধারণা পরিষ্কার থাকতে হবে এবং এটি থেকে বাঁচার জন্য সবাইকে সচেষ্ট হতে হবে।

– দৈনিক পঞ্চগড় নিউজ ডেস্ক –