• শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

  • || ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫

রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনঃ নারী শিক্ষার মহিয়সী এক বার্তাবাহক

প্রকাশিত: ৯ ডিসেম্বর ২০১৯  

“ভগিনীগণ! চক্ষু রগড়াইয়া জাগিয়া উঠুন- অগ্রসর হউন! বুক ঠুকিয়া বল মা, আমরা পশু নই। বল ভগিনী, আমরা আসবাব নই। বল কন্যে, আমরা জড়াউ অলংকার-রুপে লোহার সিন্দুকে আবদ্ধ থাকিবার বস্তু নই; সকলে সমস্বরে বল আমরা মানুষ।”

নারী জাগরণের প্রথম মন্ত্রণা এটি। এখান থেকেই তিনি শুরু করেছিলেন নারীর অধিকার আদায় এবং প্রাপ্য স্বীকৃতি পাবার আন্দোলন। যিনি অন্ধ সমাজকে অলোর পথ দেখিয়ে ছিলেন। পথ দেখিয়ে ছিলেন সামনে অগ্রসর হবার। ১৮৮০ সালের ৯ ই ডিসেম্বর রংপুর জেলার মিঠাপুকুর উপজেলার অর্ন্তগত পায়রাবন্দ গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তিনিই চোখে আঙ্গুল দিয়ে সমাজের প্রকৃত উন্নয়নের জন্য নারী-পুরুষ উভয়ের ভূমিকা কতোটা গুরুত্বপূর্ণ, তা বুঝিয়েছিলেন। তিনি নারী জাগরণের অগ্রদূত ও বাংলায় নারী শিক্ষার মহিয়সী বার্তাবাহক খ্যাতিমান বাঙালি সাহিত্যিক ও সমাজ সংস্কারক বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন।

বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন

বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন

নারী-পুরুষ সমান অংশগ্রহণ এবং অধিকার সমান ভাগাভাগি করতে না পারলে দেশের উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয়। এ প্রসঙ্গে কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেন-  "বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।"

ভারতীয় উপমহাদেশে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় বিশেষ করে শিক্ষায় সমাজকে সচেতন করতে অসামান্য অবদান রেখেছেন বেগম রোকেয়া। তিনি মনে করতেন নারী-পুরুষের মধ্যে বিভাজন নয় বরং সহযোগিতা প্রয়োজন। তার পিতা জহীরুদ্দিন মোহাম্মদ আবু আলী হায়দার সাবের ছিলেন জমিদার। তার মাতা রাহাতুন্নেসা সাবেরা চৌধুরানী। রোকেয়ার দুই বোন করিমুননেসা ও হুমায়রা, আর তিন ভাই যাদের একজন শৈশবে মারা যায়।

রংপুরের পায়রাবন্দে জন্ম নেয়া রোকেয়ার প্রকৃত নাম ছিল রোকেয়া খাতুন। বৈবাহিকসূত্রে নাম হয় রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন। কিন্তু তাকে বেগম রোকেয়া নামেই ডাকা হয়। তার পিতা আবু আলী হায়দার সাবের আরবি, উর্দু, ফারসি, বাংলা, হিন্দি এবং ইংরেজি ভাষায় পারদর্শী হলেও মেয়েদের শিক্ষার ব্যাপারে ছিলেন রক্ষণশীল। রোকেয়ার বড় দু’ভাই মোহাম্মদ ইব্রাহীম আবুল আসাদ সাবের ও খলিলুর রহমান আবু যায়গাম সাবের ছিলেন বিদ্যানুরাগী। কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে অধ্যয়ন করেন তারা আধুনিকমনস্ক হয়ে ওঠেন। রোকেয়ার বড় বোন করিমুন্নেসাও ছিলেন বিদ্যোৎসাহী ও সাহিত্যানুরাগী। বেগম রোকেয়ার শিক্ষালাভ, সাহিত্যচর্চা এবং সামগ্রিক মূল্যবোধ গঠনে বড় দু’ভাই ও বোন করিমুন্নেসার যথেষ্ট অবদান ছিল। তারাই রোকেয়াকে ঘরেই গোপনে বাংলা ও ইংরেজি শেখান।

তৎকালীন সমাজব্যবস্থায় মেয়েদের গৃহের অর্গলমুক্ত হয়ে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষালাভের কোনো সুযোগ ছিল না। পাঁচ বছর বয়সে মায়ের সঙ্গে কলকাতায় বসবাস করার সময় একজন মেম শিক্ষয়িত্রীর নিকট তিনি কিছুদিন লেখাপড়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। কিন্তু সমাজ ও আত্মীয়স্বজনদের ভ্রুকুটির জন্য তাও বন্ধ করে দিতে হয়। তবু রোকেয়া দমে যাননি। বড় ভাই ইব্রাহীম সাবের আধুনিকমনা ছিলেন। বড় ভাই-বোনদের সমর্থন ও সহায়তায় তিনি বাংলা, ইংরেজি, উর্দু, ফার্সি এবং আরবি আয়ত্ত করেন।

১৮৯৮ সালে ১৮ বছর বয়সে রোকেয়ার বিয়ে হয় বিহারের ভাগলপুর নিবাসী উর্দুভাষী সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে। তিনি ছিলেন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট, তদুপরি সমাজসচেতন, কুসংস্কারমুক্ত এবং প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন। উদার ও মুক্তমনের অধিকারী স্বামীর উৎসাহ ও সহযোগিতায় রোকেয়া দেশি-বিদেশি লেখকদের রচনার সঙ্গে নিবিড়ভাবে পরিচিত হবার সুযোগ পান এবং ক্রমশ ইংরেজি ভাষায় দক্ষতা অর্জন করেন। তার সাহিত্যচর্চার সূত্রপাতও ঘটে স্বামীর অনুপ্রেরণায়। তবে রোকেয়ার বিবাহিত জীবন বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। ১৯০৯ সালের ৩ মে সাখাওয়াত হোসেন মারা যান। ইতোপূর্বে তাদের দুটি কন্যাসন্তান জন্মগ্রহণ করে অকালেই মারা যায়।

বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন এর ভাস্কর্য

বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন এর ভাস্কর্য

১৯০২ সালে পিপাসা নামে একটি বাংলা গল্প লিখে সাহিত্যজগতে তার অবদান রাখা শুরু হয়। এরপর একে একে লিখে ফেলেন মতিচূর-এর প্রবন্ধগুলো এবং সুলতানার স্বপ্ন-এর মতো নারীবাদী বিজ্ঞান কল্পকাহিনী। এটিকে বিশ্বের নারীবাদী সাহিত্যে একটি মাইলফলক ধরা হয়। তার অন্যান্য গ্রন্থ হলো- পদ্মরাগ, অবরোধবাসিনী, মতিচুর। প্রবন্ধ, গল্প, উপন্যাসের মধ্য দিয়ে তিনি নারীশিক্ষার প্রয়োজনীয়তা আর লিঙ্গসমতার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেন। হাস্যরস আর ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের সাহায্যে পিতৃতান্ত্রিক সমাজে নারীর অসম অবস্থান ফুটিয়ে তোলেন তিনি। এসব অবদানের জন্য ঊনবিংশ শতাব্দীর খ্যাতিমান এ বাঙালি সাহিত্যিক ও সমাজ সংস্কারককে বাঙালি নারী জাগরণের অগ্রদূত হিসেবে গণ্য করা হয়।

১৯০৯ সালের ১ অক্টোবর স্বামীর প্রদত্ত অর্থে পাঁচটি ছাত্রী নিয়ে তিনি ভাগলপুরে ‘সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস’ স্কুল স্থাপন করেন। কিন্তু পারিবারিক কারণে রোকেয়া ভাগলপুর ছেড়ে কলকাতায় এসে বসবাস শুরু করেন। ১৯১১ সালের ১৬ মার্চ কলকাতার ১৩ নং ওয়ালিউল্লাহ লেনের একটি বাড়িতে মাত্র আটজন ছাত্রী নিয়ে তিনি নবপর্যায়ে ‘সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল’ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯১৬ সালের মধ্যে ছাত্রীসংখ্যা একশ পেরিয়ে যায়। স্কুল পরিচালনা ও সাহিত্যচর্চার পাশাপাশি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত রোকেয়া নিজেকে সাংগঠনিক ও সামাজিক কর্মকাণ্ডে ব্যস্ত রাখেন। ১৯১৬ সালে তিনি মুসলিম বাঙালি নারীদের সংগঠন আঞ্জুমানে খাওয়াতিনে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করেন। বিভিন্ন সভায় তার বক্তব্য তুলে ধরেন। ১৯২৬ সালে কলকাতায় অনুষ্ঠিত বাংলার নারী শিক্ষা বিষয়ক সম্মেলনে সভাপতিত।

বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়

বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়

১৯৩২ সালের ৯ ডিসেম্বর বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন। সেসময় তিনি ‘নারীর অধিকার’ নামে একটি প্রবন্ধ লিখছিলেন। তার কবর উত্তর কলকাতার সোদপুরে অবস্থিত যা পরবর্তীকালে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক অমলেন্দু দে আবিষ্কার করেন। বেগম রোকেয়া স্মরণে বাংলাদেশে প্রতিবছর ৯ই ডিসেম্বর সরকারিভাবে রোকেয়া দিবস পালন করা হয়। তার অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে মেয়েরা ধীরে ধীরে শিক্ষার আলোয় আলোকিত হবার সুযোগ পায়।

তার স্মৃতির উদ্দেশ্যে ৮ অক্টোবর ২০০৮ সালে রংপুর বিভাগে 'রংপুর বিশ্ববিদ্যালয়' প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি কোনো নারীর নামে বাংলাদেশে প্রথম পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। এছাড়াও বেগম রোকেয়ার অবদানকে চিরস্মরণীয় করে রাখতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের জন্য "রোকেয়া হল" নামকরণে একটি আবাসন করা হয়। ১৯৮০ সালে বেগম রোকেয়ার জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে শ্রদ্ধাঞ্জলি জানাতে বাংলাদেশ ডাক বিভাগ দুটি স্মারক ডাকটিকিট প্রকাশ করেছিল। তার ১৩৭ তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে গুগল তাদের হোমপেজে বেগম রোকেয়ার গুগল ডুডল প্রদর্শন করে তার জন্মদিন উদযাপন করে। গুগল ডুডলটিতে দেখা যায় সাদা পোশাকে চশমা পরা বেগম রোকেয়া বই হাতে হেঁটে যাচ্ছেন।

যোগেন্দ্রনাথ গুপ্ত রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন সম্পর্কে বঙ্গের মহিলা কবি গ্রন্থে লিখেছেন, বঙ্গের মহিলা কবিদের মধ্যে মিসেস আর, এস, হোসায়েনের নাম স্মরণীয়। বাঙ্গালাদেশের মুসলমান-নারী-প্রগতির ইতিহাস-লেখক এই নামটিকে কখনো ভুলিতে পারিবেন না। রোকেয়ার জ্ঞানপিপাসা ছিল অসীম। গভীর রাত্রিতে সকলে ঘুমাইলে চুপি চুপি বিছানা ছাড়িয়া বালিকা মোমবাতির আলোকে জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার কাছে ইংরাজী ও বাংলায় পাঠ গ্রহণ করিতেন। পদে পদে গঞ্জনা সহিয়াও এভাবে দিনের পর দিন তাহার শিক্ষার দ্রুত উন্নতি হইতে লাগিল। কতখানি আগ্রহ ও একাগ্রতা থাকিলে মানুষ শিক্ষার জন্য এরূপ কঠোর সাধনা করিতে পারে তাহা ভাবিবার বিষয়।

– দৈনিক পঞ্চগড় নিউজ ডেস্ক –