• বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ১৪ ১৪৩০

  • || ১৭ রমজান ১৪৪৫

লকডাউনে চাকরি নেই, মাশরুম চাষে ভাগ্য ফিরল যুবকের!

প্রকাশিত: ১৯ এপ্রিল ২০২১  

কুড়িগ্রামের ভূরুঙ্গামারীতে মাশরুম চাষ করে নিজের ভাগ‍্যকে বদলে দিয়ে স্বাবলম্বী হয়ে এলাকায় সাড়া ফেলেছেন আমিনুল ইসলাম মিলন নামের করোনায় কর্মহীন হয়ে পড়া এক বেকার যুবক। মাশরুম খামারি আমিনুল ইসলাম মিলনের বাড়ি উপজেলার খামার আন্ধারীঝাড় গ্রামে। বাংলাদেশের সর্ব উত্তরের দারিদ্র্যপীড়িত উপজেলার এই বেকার যুবকের মাশরুম চাষে সাফল্য পাওয়ায় এ অঞ্চলের বেকার ও কর্মহীন মানুষের মাঝে মাশরুম চাষে আগ্রহ বাড়াচ্ছে।

সরেজমিনে খোঁজ নিতে গেলে মাশরুম চাষি আমিনুল বলেন, আমি বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানের চাকরি করতাম। কিন্তু গত বছরের মহামারি করোনায় লকডাউনের কারণে সেই চাকরিটি হারাতে হয়েছে। এতে উপার্জনের পথ বন্ধ হয়ে যায় আমার। বিপাকে পড়ে যাই আমি। এ সময় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মাশরুম চাষ সম্পর্কে জানতে পারি। গত বছর নভেম্বর মাসে বগুড়ায় বেসরকারিভাবে মাশরুম চাষের ওপর ১৫ দিনের প্রশিক্ষণ নিই। পরে ডিসেম্বর মাসে নিজ বাড়িতে প্রায় সোয়া লাখ টাকা খরচ করে ৩০ ফুটের একটি টিনের ঘর নির্মাণ করি। সেখানে মাশরুমের ৬ শ স্পন দিয়ে শুরু করি মাশরুম উৎপাদনের কার্যক্রম। মাত্র দুই মাসেই ফেব্রুয়ারিতে মাশরুমের ফলন শুরু করে। প্রথম ফলনেই প্রায় ৭০ হাজার টাকার মাশরুম বিক্রি করি। বর্তমানে আমার মাশরুমের স্পন রয়েছে প্রায় ১২ শ'টি। একটি স্পন থেকে ১৫/২০ দিনের মধ্যেই মাশরুম উৎপাদন শুরু হয় যা ৩ মাস পর্যন্ত চলে। ঢাকা, সিলেট, বগুড়াসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে আমার মাশরুম নিতে আসছেন ক্রেতারা। এমনকি অনলাইনেও মাশরুম বিক্রি কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি। সেখানেও বেশ ভালোই সাড়া পাচ্ছি।

তিনি আরো বলেন, মাশরুমের উপকারিতা বিষয়ে সরকারি-বেসরকারিভাবে প্রচার করা গেলে এই মাশরুম চাষ করে অনেক বেকার ভাই-বোনেরা আমার মতো স্বাবলম্বী হতে পারবেন। এতে করে আমাদের এই দরিদ্র উপজেলার অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব‍্যাপক ভূমিকা রাখবে এবং অনেকের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে।

মাশরুম খামারের দিনমজুর মজিবর বলেন, আমিনুল মাশরুম চাষ করাতে আমার একটা স্থায়ী কাজের সুযোগ হয়েছে। প্রতিদিন এখানে কাজ করে ৩/৪ শ টাকা আয় হচ্ছে। এতে করে বেশ ভালোই চলছে সংসার। স্থানীয়ভাবে প্রতিবেশীসহ বন্ধুরা মাশরুমের প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন। এতে বেশ মাশরুম বিক্রি হচ্ছে। প্রতিবেশীরা প্রথমে মাশরুম খেতে না চাইলেও এখন এর উপকার জানতে পেরে অনেকেই মাশরুম কিনে নিয়ে খাচ্ছেন।

মাশরুম বাজারজাত ও মাশরুমের উপকারিতার প্রচার বৃদ্ধি পেলে এই উপজেলার অর্থনৈতিক উন্নয়নে মাশরুম চাষ বড় ভূমিকা রাখবে বলে জানিয়েছেন এলাকার বিশিষ্টজনেরা।

মাশরুমের উপকারিতা ও পূষ্টিগুণ সম্পর্কে কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজের উপাধ্যক্ষ ও উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের অধ‍্যাপক মীর্জা মো. নাসির উদ্দিন বলেন, 'মাশরুম একটি মৃতজীবী ছত্রাক জাতীয় উদ্ভিদ। মাশরুমে মধ্যে রয়েছে আমিষ, শর্করা, চর্বি, ভিটামিন এবং মিনারেলের সমন্বয়। যা শরীরের ইমিউন সিস্টেমকে উন্নত করে। মাশরুমে আছে শরীরের কোলেস্টেরল কমানোর অন্যতম উপাদান ইরিটাডেনিন, লোভস্টটিন এবং এনটাডেনিন। তাই নিয়মিত মাশরুম খেলে হৃদরোগ ও উচ্চরক্তচাপ নিরাময় করে। মাশরুমে প্রচুর পরিমাণে ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, ভিটামিন-ডি আছে। যা শিশুদের দাঁত ও হাড় গঠনে অত্যন্ত কার্যকারী। এতে আছে প্রচুর পরিমাণে ফলিক এসিড ও লৌহ। ফলে মাশরুম খেলে রক্তশূন্যতা দূর হয়। মাশরুমে বি-ডি গ্লুকেন, ল্যাম্পট্রোল, টারপিনওয়ডে এবং বেনজো পাইরিন। এটি ক্যান্সার ও টিউমার প্রতিরোধে কার্যকর ভূমিকার রাখে। গর্ভবতী মা ও শিশুরা নিয়মিত মাশরুম খেলে দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়'।

মাশরুমে চর্বি ও শর্করা কম এবং আঁশ বেশি থাকায় ডায়াবেটিস রোগীদের জন‍্য এটি আদর্শ খাবার। মাশরুম প্রতিদিন ন্যূনতম ১ চা চামচ গুড়া মাশরুম স্যুপ, চা, কফি, হরলিক্স, গরম দুধ, গরম পানি, লাচ্চি, শরবত, ডাল, তেঁতুলের চাটনি ও রুটির আটার সাথে মিশিয়ে অথবা যেকোনো তরকারির সাথে মিশিয়ে খাওয়া যায়।

তিনি আরো বলেন,এমন হাজারো গুণাগুণ সম্বলিত মাশরুম বাজারজাত করণে নেই কোনো উদ্যোগ। মাশরুম সরকারি-বেসরকারিভাবে বাজারজাত করা গেলে জেলায় মাশরুমের চাষ আরো বৃদ্ধি পাবে। এতে করে দারিদ্র্যপীড়িত হিসেবে খ্যাত জেলায় কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে পাশাপাশি অর্থনৈতিক উন্নয়নে অগ্রণী ভূমিকা রাখবে বলে মনে করেন তিনি।

ভূরুঙ্গামারী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আসাদুজ্জামান বলেন, মাশরুম একটি পূষ্টিকর খাদ‍্য। এই উপজেলায় মাশরুম চাষ বৃদ্ধির জন‍্য বেকারদের আমরা বিভিন্নভাবে উৎসাহ ও সহযোগিতার আশ্বাস দিচ্ছি যাতে তারা আমিনুলের মতো মাশরুম চাষ করে ভাগ‍্য বদলিয়ে স্বাবলম্বী হতে পারে।

কুড়িগ্রাম কৃষি অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. মঞ্জুরুল হক বলেন, মাশরুম একটি পুষ্টিকর খাবার। এটি তরকারি হিসেবে সাধারণ মানুষ খেতে পারবেন। স্বাস্থ্যকর পরিবেশে মাশরুম উৎপাদন করছেন আমিনুল। সে অনলাইনের মাধ্যমে মাশরুম বাজারজাত করছে। মাশরুম ২ শ টাকা কেজিতে বিক্রি হয়ে থাকে। বর্তমানে আমিনুলের প্রায় ১২ শ স্পন রয়েছে। এখান থেকে একমাসেই আমিনুল আরো ৮০ হাজার টাকার মাশরুম বিক্রি করতে পারবে। আমিনুলের সাফল্য দেখে অনেকেই মাশরুম চাষে উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন বলে জানান তিনি।

– দৈনিক পঞ্চগড় নিউজ ডেস্ক –