• শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ১৪ ১৪৩০

  • || ১৮ রমজান ১৪৪৫

সমুদ্রবিদ্যায় মুসলিম নাবিকদের অমর কীর্তি

প্রকাশিত: ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২১  

খ্রিস্টীয় ১৫ শতকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত মুসলিম ব্যবসায়ীরা মরক্কো থেকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া পর্যন্ত ব্যবসা বিস্তার করেছিলেন এবং মুসলিম নাবিকরা চীন থেকে হরমুজ, এডেন, মোম্বাসা ও পশ্চিম ইউরোপ পর্যন্ত গৌরবজনক বহু অভিযান পরিচালনা করেছিলেন। এমনকি কলোম্বাসের প্রথম সমুদ্র যাত্রারও আগে যখন বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চল সম্পর্কে ইউরোপীয়দের জ্ঞানচর্চার ভিত্তি ছিল পর্যটকদের হাতে আঁকা নকশা, কিছু প্রাচীন মানচিত্র ও ভূ-তাত্ত্বিক তথ্যাবলি—যেগুলো সম্প্রতি আবিষ্কৃত হয়েছে এবং যা ছিল প্রাচীন গ্রিক থেকে অনূদিত; তখন মুসলিম নাবিক ও সমুদ্র বিজ্ঞানীরা অসামান্য সব কর্মযজ্ঞ সম্পন্ন করেন।

ইতিহাসের কীর্তিমান মুসলিম নাবিক

১৫ শতকে নৌপথ ও ভূগোল বিদ্যায় বিশেষ ভূমিকা রাখা কয়েকজন মুসলিম নাবিকের পরিচয় তুলে ধরা হলো—

ইবনে মাজিদ: বর্তমান ইরাকের নজদের একটি নাবিক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন আহমেদ ইবনে মাজিদ। তাঁর পিতা ও দাদা সমুদ্রবিদ্যার শিক্ষক ছিলেন। লোহিত সাগর ছিল তাঁদের নখদর্পণে। লোহিত সাগর থেকে পূর্ব আফ্রিকা, পূর্ব আফ্রিকা থেকে চীন পর্যন্ত বিস্তৃত তৎকালীন সমুদ্রপথগুলো সম্পর্কে ইবনে মাজিদ বিপুল তথ্য, জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। নৌবিদ্যা ও সমুদ্রপথ নিয়ে ইবনে মাজিদের ৩৮টি গ্রন্থ রয়েছে। যার কিছু গদ্যে এবং অন্যগুলো পদ্যে রচনা করেন। তাঁর রচিত গ্রন্থগুলোর মধ্যে ২৫টি এখনো পাওয়া যায়। তিনি এসব গ্রন্থে জ্যোতির্বিদ্যা, প্রাকৃতি বিদ্যা, চাঁদের অবস্থানস্থল, সমুদ্রপথ ও অক্ষাংশ বিষয়ে আলোচনা করেছেন।

তাঁর বিখ্যাত বই ‘কিতাবুল ফাওয়ায়িদ ফি উসুলিল ইলমিল বাহরি ওয়াল কাওয়াইদ’ (ব্যাবহারিক সমুদ্রবিদ্যা : মূলনীতি ও বিধান)। ১৪৯০ খ্রিস্টাব্দে লেখা বইটি সমুদ্র বিষয়ক তথ্যাবলির ক্ষেত্রে বিশ্বকোষের মর্যাদা লাভ করেছিল। এ বইয়ে তিনি নৌযান পরিচালনা, আবহাওয়া ও বাতাসের গতিবিধি, বৃষ্টিপাত, নক্ষত্রের ব্যবহার সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি পূর্ব আফ্রিকা থেকে ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত সমুদ্র বন্দরগুলোর অবস্থানও তুলে ধরেছেন।

সুলাইমান আল-মাহরি: খ্রিস্টীয় ১৬ শতকে খ্যাতি লাভ করেন সুলাইমান আল-মাহরি। আধুনিককালে তাঁর অবদান মানুষের সামনে তুলে ধরেছেন ঐতিহাসিক ফুয়াদ সেজগিন। মাহরি তাঁর চার খণ্ডের ‘মিনহাজ আল-ফাহির’ গ্রন্থে ভারত মহাসাগরের গাণিতিক অবকাঠামো তুলে ধরেছেন, যা তৎকালীন মুসলিম বিশ্বে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছিল। আল-মাহরির গাণিতিক অবকাঠামো নাবিকদের সমুদ্রতট নির্ণয়ে অনেক বেশি সহায়ক ছিল। তিনি তাঁর বইয়ে পূর্ব আফ্রিকান উপকূল থেকে সুমাত্রা-জাভার দূরত্বসহ ৬০টি সমুদ্রপথের দূরত্ব নির্ণয় করেন। এ ছাড়া তিনি ভারত মহাসাগরের তীরবর্তী অসংখ্য দ্বীপ, উপদ্বীপ ও সমুদ্রবন্দরের অবস্থান চিহ্নিত করেন।

পেরি রেইস: তুর্কি নাবিক পেরি রেইস ছিলেন খিস্টীয় ১৬ শতকের একজন খ্যাতিমান সমুদ্র বিশেষজ্ঞ। ‘কিতাব-ই-বাহরিয়া’ (সমুদ্রযাত্রীর বই) তাঁকে সীমাহীন খ্যাতি এনে দেয়। এ বইয়ে মূলত তিনি ভূমধ্য সাগর, ভূমধ্য সাগরের উপসাগর, উপকূল, দ্বীপ, খাত, জলপ্রণালী ইত্যাদি বিষয়ের অবতারণা করেছেন। এ ছাড়া এতে তিনি জাহাজ পরিচালনা, প্রতিকূল পরিস্থিতিতে নোঙর করা ও নিরাপদ আশ্রয়ে পৌঁছানোর উপায় সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। ২১৯টি পূর্ণাঙ্গ বিবরণীতে তিনি ভূমধ্য সাগর ও কৃষ্ণ সাগরের বিস্তারিত রূপরেখা তুলে ধরেছেন। ল্যাটিন, তুর্কি ও ইংরেজি অনুবাদসহ সম্প্রীতি মূল্যবান এ বইটি পুনঃপ্রকাশিত হয়েছে। এ ছাড়া পেরি রেইস ১৫১৩ সালে বিশ্ব মানচিত্র আঁকেন। আধুনিককালে আবিষ্কৃত প্রাচীন মানচিত্রগুলোর মধ্যে শুধু তাঁর মানচিত্রেই আমেরিকার অবস্থানের উল্লেখ পাওয়া যায়। মানচিত্র অঙ্কনের পাঁচ শ বছর পূর্তি উপলক্ষে ২০১৩ সালে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা ইউনেসকো তা বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকাভুক্ত করে।

জিং হি (১৩৭১-১৪৩৫ খ্রি.): চীনা নৌবহরের অ্যাডমিরাল ছিলেন জিং হি। তিনি ভাস্কর দ্য গামা ও ক্রিস্টোফার কলম্বাসের আগে মক্কা, পারস্য উপসাগর, পূর্ব আফ্রিকা, শ্রীলঙ্কা ও আরব অঞ্চলগুলো ভ্রমণ করেন। তিনি ৬২টি রাজকীয় জাহাজের নেতৃত্ব দেন, যার প্রত্যেকটির ওজন ছিল ৩১০০ মেট্রিক টন। অন্যদিকে কলম্বাসের জাহাজের ওজন ছিল ৯১ মেট্রিক টন। ২৮ বছরের নাবিক জীবনে জিং হি ৩৭টি দেশ ভ্রমণ করেন; বাণিজ্যিক ও কূটনৈতিক প্রতিনিধি হিসেবে সাতটি দূরবর্তী সমুদ্রযাত্রা পরিচালনা করেন। চীনা মুসলিমদের ছোট একটি দল নিয়ে তিনি পবিত্র মক্কা নগরী সফর করেন। সমুদ্রযাত্রার সময় তিনি বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার, রত্ন, প্রাকৃতিক সম্পদ, উদ্ভিদ, প্রাণী, ওষুধ ইত্যাদি নিয়েও গবেষণা করেন, যা তাঁর সমুদ্রযাত্রাকে ভিন্ন মাত্রা দেয়।

জাকারিয়া ইবনে মুহাম্মদ আল-কাওয়াজিনি: খ্রিস্টীয় ১৩ শতকের এই মুসলিম বিজ্ঞানী পদার্থবিদ্যা, জ্যোতির্বিদ্যা ও ভূগোল নিয়ে কাজ করেন। তাঁর রয়েছে একাধিক সমুদ্রযাত্রার অভিজ্ঞতা। সামুদ্রিক প্রাণী নিয়ে তাঁর উচ্চতর গবেষণা রয়েছে। তাঁর গবেষণা স্থান পেয়েছে চীন সাগরে প্রাণী জগতের বিস্ময়কর বিকাশ, দৈত্যাকৃতির মাছ (তিমি), বিশালকায় কচ্ছপ, রাক্ষুসে নিশাচর সাপ, যারা বন্য হাতি ও মহিষ পর্যন্ত খেয়ে ফেলতে পারে।

ইবনে খারদাজবিহ: আবুল কাসিম উবায়দুল্লাহ ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে খারদাজবিহ অষ্টম শতাব্দীর মুসলিম ভূগোলবিদ ও নাবিক। তাঁর বিখ্যাত বই ‘কিতাবুল মাসালিক ওয়াল মামালিক’। এ বইয়ে তিনি মুসলিম বিশ্বের বাণিজ্যিক পথগুলোর বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন, যার মধ্যে চীন, কোরিয়া, জাপানসহ দক্ষিণ এশিয়ার উপকূলীয় অঞ্চল, ব্রহ্মপুত্র নদ, আদমান দ্বীপপুঞ্জ, মালায়া ও জাভা দ্বীপের বিবরণ রয়েছে।

– দৈনিক পঞ্চগড় নিউজ ডেস্ক –