• শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ৬ ১৪৩১

  • || ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

সর্বশেষ:
বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার অন্যতম নকশাকার বীর মুক্তিযোদ্ধা শিব নারায়ণ দাস, আজ ৭৮ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেছেন। বন্যায় দুবাই এবং ওমানে বাংলাদেশীসহ ২১ জনের মৃত্যু। আন্তর্জাতিক বাজারে আবারও বাড়ল জ্বালানি তেল ও স্বর্ণের দাম। ইসরায়েলের হামলার পর প্রধান দুটি বিমানবন্দরে ফ্লাইট চলাচল শুরু। ইসরায়েল পাল্টা হামলা চালিয়েছে ইরানে।

দেবীগঞ্জে অবশেষে স্বাভাবিক জীবনে ফিরলেন সেই দম্পতি

প্রকাশিত: ১৩ আগস্ট ২০২১  

পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জ উপজেলায় হিল্লা বিয়েতে রাজি না হওয়ায় দীর্ঘ তিন মাস সমাজচ্যুত হওয়ার পর অবশেষে স্বাভাবিক জীবন ফিরে পেয়েছেন আয়নাল হক ও জমিরন বেগম দম্পতি।

বৃহস্পতিবার (১২ আগস্ট) বিকেল থেকে ওই দম্পতি তাদের নিজ বাড়িতে একসঙ্গে বসবাস করতে শুরু করেছেন। শুধু তাই নয়, তাদের বাড়িতে আসতে শুরু করেছে পরিবারের সদস্য, পাড়া- প্রতিবেশী ও আত্মীয়-স্বজন।

জানা গেছে, আয়নাল-জমিরন দম্পতি জেলার দেবীগঞ্জ উপজেলার সুন্দরদিঘী ইউনিয়নের ছলিমনগর এলাকার বাসিন্দা। ৩৫ বছর আগে তারা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তাদের দুই ছেলে ও দুই মেয়ে রয়েছে। ছেলে-মেয়েদের বিয়েও দিয়েছেন।

তিন মাস আগে পারিবারিক কলহের জেরে আয়নাল ও জমিরন দম্পতির মধ্যে ঝগড়া হয়। এক পর্যায়ে আইনাল তার স্ত্রীকে তালাক বলে। এ ঘটনায় হিল্লা বিয়ে না দেওয়া পর্যন্ত তারা সমাজে উঠাবসা ও চলাফেরা করতে পরেবে না বলে জানায় সমাজপতিরা। তবে আয়নাল হিল্লা বিয়ে দেবেন না বলে জানিয়ে দেয়। এতে তিন ধরে তাদের একঘরে করে রাখা হয়। অবশেষে ওই দম্পতির অভিযোগ পেয়ে দেবীগঞ্জ উপজেলা ও পুলিশ প্রশাসনের মাধ্যমে বৃহস্পতিবার দুপুরে ছলিমনগর উচ্চ বিদ্যালয়ে স্থানীয়দের নিয়ে এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে ওই দম্পতির ওপর থেকে সকল বিধি-নিষেধ প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়।

এ সময় দেবীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা প্রত্যয় হাসান, দেবীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জামাল হোসেন, সুন্দরদিঘী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান পরেশ চন্দ্র রায়, ইউপি সদস্য লক্ষণ রায়, মসজিদ কমিটির সভাপতি নাছির উদ্দিন ও সাধারণ সম্পাদক মোমিরুল ইসলাম, স্থানীয় বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষসহ স্থানীয় গণমাধ্যমকর্মীরা উপস্থিত ছিলেন।

ছলিমনগর জামে মসজিদ কমিটির সভাপতি নাসির উদ্দীন ও সাধারণ সম্পাদক মোমিনুর ইসলাম বলেন, স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়ার এক পর্যায়ে আয়নাল ও জমিরন একে অপরকে মৌখিকভাবে তালাক দেওয়ার বিষয়টি উচ্চারণ করেছিলেন। এরপর বিষয়টি ওই গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে। পরে স্থানীয় হাফেজ মোস্তফা কামালের সহযোগিতায় ফুলবাড়ি বাজার এলাকার মুফতি আনোয়ার হোসাইনকে নিয়ে আসা হয়। পরে তিনি তালাক হয়েছে বলে আমাদের জানান। তিনি বলেন, তাদের হিল্লা বিয়ে (কমপক্ষে তিন দিনের জন্য অন্যের সঙ্গে বিয়েতে আবদ্ধ হওয়া) দিতে হবে। তারা একে অপরের সঙ্গে দেখা, কথা বলা, চলা-ফেরা করতে পারবে না। তাদের সমাজচ্যুত করতে হবে।

এ সিদ্ধান্ত হওয়ার পর সমাজের লোকজন তাদের একঘরে করে রাখে। তবে তারা ভুল স্বীকার করে বলেন, আমরা কোরআন হাদিস বিষয়ে তেমন জানি না। ওই হাফেজ ও মুফতি ফতোয়া দেয়, তাদের হিল্লা বিয়ে দিতে হবে, নয়তো তাদের সমাজচ্যুত করে একঘরে করতে হবে।

এ বিষয়ে ভুক্তভোগী আয়নাল হক বলেন, রাগের বশে আমি আমার স্ত্রীকে তালাক দেওয়ার কথা বলি। পরে সমাজপতিদের চাপে দিনাজপুরের খানসামা উপজেলার আমতলী বাজারের মাওলানা জাহাঙ্গীরের বাসায় আমরা আবার বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হই। তারপরও সমাজপতিরা আমাদের একত্রে বসবাস করতে দেয়নি। যারা কোরআন হাদিসের অপব্যাখ্যা দিয়ে অন্যায়ভাবে আমাদের সঙ্গে এমন করেছে আমরা তাদের বিচার চাই। যেন অন্য কারো সঙ্গে তারা এমনটি করতে না পারে। বৈঠকে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেও আমরা এখনো নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি।

ভুক্তভোগী জমিরন বেগম জানান, আমি ও আমার স্বামী হিল্লা বিয়েতে রাজি না হওয়ায় সমাজের লোকজন আমাদের একঘরে করে রাখে। আমরা আমাদের ছেলে-মেয়েদেরর সঙ্গেও কথা বলতে পারিনি। আমাদের একঘরে রেখে তারা আমাদের সমাজচ্যুত করে রাখে। আমরা অনেক কষ্টে দিন পার করেছি। সমাজপতিদের হাত-পা ধরেছি কেঁদেছি। তবুও কারো মন গলেনি। আমাদের কোথাও যেতে দেননি। স্থানীয় লোকজনও হুমকি ধামকি দেয়। যে হাফেজ ও মুফতি ভুল ফতুয়া দিয়ে আমাদের সম্মানহানি করল, তাদের বিচার চাই আমরা। আমরা এখনো নিরপেক্ষতাহীনতায় ভুগছি।

সুন্দরদিঘী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান পরেশ চন্দ্র রায় জানান, আয়নাল হক ও জমিরন বেগমের বিষয়টি সমাধানে এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিদের বলেছিলাম। তারা আমার কথা না শুনে হিল্লা বিয়ের সিদ্ধান্ত নেয়। উপায় না দেখে ওই দম্পতি আমার কাছে আসে। পরে আমি তাদের উপজেলা প্রশাসন বরাবর লিখিত অভিযোগের পরামর্শ দেই।

এ বিষয়ে দেবীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জামাল হোসেন বলেন, আমরা খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে সমাজপতিদের সঙ্গে ওই দম্পতিকে মিলিয়ে দিয়েছি। ওই এলাকায় কুসংস্কারাচ্ছন্ন ও ধর্মান্ধ কিছু মানুষ হিল্লা বিয়েকে কেন্দ্র করে উত্তেজনা সৃষ্টি করেন। তবে এ ঘটনায় যারা ভুল ফতোয়া দিয়ে সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেছে তাদের  বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা গ্রহণ করব। এ বিষয়ে কেউ যদি আবার কোনো বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে, তাদের আইনের আওয়তায় আনা হবে।

দেবীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) প্রত্যয় হাসান বলেন, ওই দম্পতির অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে পুলিশ, জনপ্রতিনিধি ও স্থানীয় গণ্যমান্য ও সমাজপতিদের নিয়ে বৈঠকে বসেছিলাম। বৈঠকে কোরআন হাদিসের আলোকে তালাক কিভাবে হয় বা হয় না এ বিষয়টি সবাই বোঝানো হয়। সবাই তাদের ভুল শিকার করে ক্ষমা চায়। পরে ওই দম্পতির সঙ্গে সমাজের সবার মিল করে দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে ওই দম্পতি তাদের পরিবারের সঙ্গে বসবাস করছেন।

– দৈনিক পঞ্চগড় নিউজ ডেস্ক –